কম-জানার অতৃপ্তি মেটে না কখনো

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন

ফ্রাঙ্কো ফারিনা- ইটালিয়ান ফিল্ম আর্কাইভের কিউরেটর। তাঁর সাথে বন্ধুত্ব নিশিথ সূর্যের দেশ অসলোতে ২০১০ সালের মে মাসে। পৃথিবীর ১১৪টি দেশের ফিল্ম আর্কাইভের নির্বাহীরা যোগ দিয়েছেন ‘ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভস্’ (FIAF)-এর ৬৬তম কংগ্রেসে। কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের জন্য অসলো নগরীর মেয়র ৩রা মে তারিখে ঐতিহাসিক সিটি হলে এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন। আমরা পায়ে হেঁটে চলেছি গন্তব্যের দিকে। কথা প্রসঙ্গে ফারিনা আমাদের বাঙালির গর্ব, নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী কবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে নতুন নতুন অনেক তথ্য উপস্থাপন করে সবাইকে একবারে তাক লাগিয়ে দিতে শুরু করল। দলে উপস্থিত এশীয়দের মধ্যে আমিই একমাত্র বাঙালি, সুতরাং একটু অস্বস্তিতে ভুগছি। এরপর আমাকে তো কিছু বলতে হবে! কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গর্ব যতই করি না কেন, তাঁর সম্পর্কে জানাশুনার দৌড় তো প্রায় শূন্যের কোঠায়। যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই – হঠাৎ ফারিনা আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, আরে তোমাদের টেগোর তো এই সিটি হল থেকেই নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে আমার কিছু জানা ছিল না, আমাদের কবি এশীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম নোবেল পুরস্কার অর্জন করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, সেটাই তো যথেষ্ট, কোন জায়গা থেকে তিনি সেটা গ্রহণ করেছেন, তা জানার এতো কী প্রয়োজন? আম্তা আম্তা করে বললাম, তাই নাকি! বলেছি সরলভাবে- কিন্তু ইউরোপীয়রা আমার অজ্ঞতা ধরতে পেরে হো হো করে হেসে উঠল। আমার তখন ধরিত্রী দ্বিধা হও অবস্থা। দেশে ফিরে রবীন্দ্র বিশারদ হিসেবে ধরলাম সুব্রত কুমার দাসকে, বলুন তো রবীন্দ্রনাথ কোন স্থান থেকে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন, অসলো থেকে কি না?

সুব্রতকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার কারণ, তাঁকে দেখেছি দার্শনিক সক্রেটিসের মতো, অনেক পণ্ডিতমন্য ব্যক্তিদেরও এ ধরনের প্রশ্ন করে একেবারে কুপোকাত করে ফেলতে। সেদিন সুব্রত গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করলেন, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সদুত্তর দিলেন না। কঠিন একটা প্রশ্ন করতে পারায় বেশ আত্মশ্লাঘা বোধ করলাম। কিন্তু বিধি বাম, কিছুদিন যেতে না যেতেই একদিন সকালে তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ এক ক্ষুুদে বার্তা পাঠালেন, অমুক পত্রিকা দেখুন, আমার একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

পত্রিকাটি জোগাড় করে দেখি রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি বিষয়ে স্থান-কাল-পাত্র-ঠিকুজিসহ তাঁর দশাসই আকারের এক নিবন্ধ রয়েছে তাতে। আনন্দে মন ভরে গেল। কালবিলম্ব না করে টানা নিশ্বাসে শেষ করলাম লেখাটা। তাতে আছে- সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর সুইডিশ সাহিত্য একাডেমির নোবেল কমিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)-এর নাম ঘোষণা করে ওই বছরের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে। ইংল্যান্ডের রয়াল সোসাইটি অব লিটারেচারের সদস্য স্টার্জ মুর ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রনাথকে পুরস্কৃত করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সুইডেনের সমকালীন খ্যাতিমান কবি কার্ল গুস্তাফ হেইডেন ভন স্টাম (১৮৫৯-১৯৪০) ভীষণ তৎপর ছিলেন যাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরস্কারটি পান, তিনি মনে করতেন সমকালীন পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় কোনো দাবিদার নাই এ পুরস্কার অর্জনের জন্য। যদিও টমাস হার্ডি (১৮৪০-১৯২৪), গ্রাসিয়া দেলেদ্দা (১৮৭৫-১৯৩৬), আনাতোল ফ্রাঁস (১৮৪৪-১৯২৪) ও তাঁর নিজের নামসহ ২৮ জন বিশ্বখ্যাত কবি সাহিত্যিকের নাম সে বছর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রার্থীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর ইংরেজ কবি ইয়েটস-এর মতে, তাঁর সময়ে ইংরেজি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের সমতূল্য কোনো কবি ছিলেন না পৃথিবীতে।

রবীন্দ্রনাথের কাছে পুরস্কারপ্রাপ্তির সংবাদ পৌঁছে ১৫ নভেম্বর টেলিগ্রামের মাধ্যমে, ১৭ নভেম্বর তিনি এর জবাব পাঠান। সরকারের অনুমতি না থাকায় ১৯১৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে স্টকহোমে আয়োজিত নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে নিজে উপস্থিত থেকে রবীন্দ্রনাথ সে সময় পুরস্কার গ্রহণ করতে পারেন নাই। সুইডেনের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত মি. ক্লাইভ নোবেল কমিটির কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সোনার মেডেল আর ডিপ্লোমা গ্রহণ করেন। তবে কবি রাষ্ট্রদূতের হাতে নোবেল কমিটিকে একটি ধন্যবাদ বার্তা প্রেরণ করেছিলেন, এতে তিনি লিখেছিলেন – দূরকে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই। পরবর্তীতে ১৯১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি কলকাতার গভর্নর হাউসে সে পুরস্কার রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দেন লর্ড কারমাইকেল, আর কবি স্টকহোমে তাঁর নোবেল বক্তৃতা করেছিলেন এ ঘটনার সাত বছর পরে ১৯২১ সালের ২৬ মে। (পৃ. ১১-১৯)

মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল, লেখককে মনপ্রাণ ভরে ধন্যবাদ জানাই। তবে একটু অনুশোচনাও হলো, লেখকের ওপর খানিক রাগও হলো, তিনি আর কিছুদিন আগে কাজটি করলেন না, তাহলে সেদিন হয়তো ওরকম নাকাল হতে হতো না! সুব্রত কুমার দাসের রবীন্দ্রনাথ কম-জানা অজানা গ্রন্থের প্রথম অনুচ্ছেদ মনে হয় পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁরই সেই অবিস্মরণীয় নিবন্ধটির পুনর্পাঠ। ক্ষুরধার প্রতিভার অধিকারী এ লেখক এখানেই থেমে থাকেননি, শ্রমসাধ্য গবেষণার মাধ্যমে রবীন্দ্রপ্রতিভার ভিন্ন আঙ্গিক ও এক সমুদ্র অজানা তথ্যের বিশাল ভাণ্ডার বিশ্বকর্মার মতো বয়ে এনে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের সামনে এ গ্রন্থের মোট বারোটি অধ্যায়ে।

রবীন্দ্র প্রতিভার ভিন্ন আঙ্গিক বলতে এ গ্রন্থে লেখক বিশ্বকবির গুণমুগ্ধ অনেক নিবেদিতপ্রাণ প্রান্তিক লেখক, প্রতিবেদক, জীবনীকার, রবীন্দ্র সাহিত্যের বিস্মৃতপ্রায় আলোচক ও সমালোচকের দুর্ভাগ্য ও দুর্দশার কথা বলেছেন- যারা স্বয়ং কবির কাছ থেকে অথবা তাঁর জীবনীকারদের কাছ থেকে অবহেলার শিকার হয়েছেন, রবীন্দ্র জীবনীগুলোর কোনোটাতেই এঁদের কথা উল্লেখ নাই। কিন্তু প্রতিভার বিচ্ছুরণ কিংবা গুণেমানে কোনো বিবেচনাতেই তাচ্ছিল্য করার মতো অযোগ্য তাঁরা ছিলেন না। লেখক এখানে শিল্পীর দৃষ্টিতে সমবেদনার রঙ মাখিয়ে রবীন্দ্রপ্রতিভার বিকাশে এই সব নিবেদিতপ্রাণ মানুষের অপরিসীম শ্রম, ত্যাগ ও বঞ্চনার অজানা অধ্যায়ের ছবি এঁকেছেন। নিবিষ্টপ্রাণ গবেষকের মতো এ গ্রন্থে আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়ার বহু পত্রপত্রিকার কথাও তুলে এনেছেন লেখক, যে গুলোর অবদান ছাড়া রবীন্দ্র প্রতিভার বিশ্ববিজয়ই হয়তো অপূর্ণাঙ্গ হয়ে যেত। তখনকার বিশ্বপ্রেক্ষাপটে অপরিচিত এক বাঙালি কবির সন্ধান বিশ্বসভায় পৌঁছে দিয়েছে এই সব অসামান্য ব্যক্তিবর্গ, গণমাধ্যম ও তাঁর অগণিত কর্মীরা। কিন্তু বিনিময়ে শুধু বঞ্চনাই কি এদের প্রাপ্য। এরা কি শুধু পাদপ্রদীপের আলোর নিচে আত্মাহুতি দেওয়া গুরুত্বহীন পতঙ্গের মতো? মোটই তা নয়, বিশ্বকবির সার্ধ্বশত জন্মবার্ষিকীর সমকালে এঁদের অবদানের কথাও বিশ্বসভায় জানাতে হবে। নইলে বাঙালির মহানায়ক রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার গগণেও কলঙ্কের তিলক লেগে থাকবে। আজ তার অপণোদন ঘটাতে হবে। সেই মহান বিদ্রোহের সুরই ধ্বনিত হয়েছে সুব্রত কুমার দাসের শক্তিশালী লেখনীতে রবীন্দ্রনাথ কম-জানা অজানা শীর্ষক গ্রন্থের পুরো আখ্যানভাগ জুড়ে।

বঞ্চনার শিকার লেখকদের কথা বলা শুরু হয়েছে ‘বিস্মৃত এক রবীন্দ্র ভাষ্যকার’ শীর্ষক অধ্যায় থেকে। জানা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চাশতম জন্মদিন উপলক্ষে ১৯১১ সালে তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠক অজিত কুমার চক্রবর্তী (১৮৮৬-১৯১৮) দু’টি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন- বিষয় ‘রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক কবি-জীবনী এবং ‘কাব্য-পরিক্রমা’ শীর্ষক কবিতার আলোচনা। একই বছর তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এর পরপরই প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ জীবনস্মৃতি এবং পণ্ডিত বিনয়কুমার সরকারের রবীন্দ্র-সাহিত্যে ভারতের বাণী শীর্ষক দু’খানি গ্রন্থ। পাশ্চাত্যে রবীন্দ্র সাহিত্য ও দর্শনের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে বিনয়কুমারের গ্রন্থখানির গুরুত্ব অপরিসীম। বিনয়কুমারের পৈত্রিক নিবাস ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে। মালদহ জেলা স্কুল থেকে ১৯০১ সালের এন্ট্রাস পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি ছিলেন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। তিনি স্বদেশী বিপ্লবী ছিলেন, পৃথিবীর বহুদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ঐশ্বর্য বৃদ্ধির ব্যাপারে সক্রিয় এক ধনবান মানুষ। রবীন্দ্র-সাহিত্যে ভারতের বাণী শীর্ষক গ্রন্থে তিনি রবীন্দ্র সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কিত ২০টি স্বরচিত প্রবন্ধের সন্নিবেশ ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্র জীবনীগুলিতে তাঁর এ গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করা হয়নি প্রায় কোথাও, বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেছে। (পৃ. ২০-৩২)

রবীন্দ্রনাথের প্রথম ইংরেজি জীবনী লেখেন অধ্যাপক বসন্ত কুমার রায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকন্সিন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি অধ্যাপক ও বাংলাদেশের বরিশালের সন্তান বসন্তকুমার রায় রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আগে থেকেই তাঁর জীবন, কবিতা ও কাব্য সম্পর্কে আমেরিকার পত্রপত্রিকায় লিখে আসছিলেন। রবীন্দ্রকাব্যের গভীরতা নিয়ে আলোচনা এবং শীঘ্রই রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন এমন ভবিষ্যৎ বাণীও করেছিলেন তিনি। এমন কী রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়ার অব্যবহিত পরে আমেরিকান প্রেসে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয় তাতেও বসন্তকুমারকে উদ্ধৃত করে রবীন্দ্রনাথের কাব্য এবং ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে তথ্য পরিবেশন করা হয়। তাঁরই রচিত Rabindranath Tagore: The Man and His Poetry শীর্ষক গ্রন্থ ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। বিদেশে রবীন্দ্র প্রতিভাকে প্রচারের অভিনন্দনযোগ্য প্রয়াস হলেও এ গ্রন্থের লেখক বসন্তকুমারকে পছন্দ করেননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কারণ – নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর লেখক তাঁর সম্পর্কে আগ্রহকে নানাভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন এবং অনুমতি ছাড়া তাঁর রচনার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন – রবীন্দ্রনাথ এ মর্মে অভিযোগ পেয়েছিলেন ইলিনয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিসেস বিভাগের প্রধান ড. আর্থার সেইমুরের স্ত্রী মেইসি এফ. সেইমুরের কাছ থেকে, পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখা মেইসির পত্রের মাধ্যমে। রবীন্দ্র জীবনীকাররা কোথাও গ্রন্থটির ও গ্রন্থকারের নামোল্লেখ করেন নি, কেউ কেউ তাঁকে Bad Translator হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লেখা পত্রে বসন্তকুমার রায় সম্পর্কে তাঁর অশ্রদ্ধার কথা উল্লেখ করেছেন। কবির অভিযোগ- বসন্ত কুমার তাঁর লেখা চুরি করে, সে সংবাদপত্রে গুজব রটায়, নিজেকে তাঁর বিশেষ বন্ধু বলে পরিচয় দেয়, ব্যবসার খাতিরে তাঁর স্তব করে, আমেরিকায় তাঁর বন্ধুরা সবাই লোকটিকে ঘৃণা করে। কবির ঘৃণা এতটাই প্রকট যে তিনি বসন্ত কুমারের পাঠানো বইটি ছুঁয়েও দেখতে চান না। এমন কী কবি তাঁর পাঠানো বইয়ের কপিটি ফেরত পাঠানোর নির্দেশ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য অশ্বেতাঙ্গ এবং এশীয় হিসেবে রবীন্দ্রনাথই প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। ঠিক সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ এবং ভারতীয় অন্যান্য বিষয় নিয়ে বসন্তকুমার রচিত বহু ইংরেজি প্রবন্ধ-নিবন্ধ আমেরিকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছিল, যার একটি বাণিজ্যিক দিক ছিল। এই বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কেন্দ্রে বসন্তকুমার নামক কোনো বাঙালি থাকুক, রবীন্দ্রাথ ঠাকুরের শ্বেতাঙ্গ বন্ধুরা হয়তো তা চাননি। এ কারণে হয়তো তারা পত্র মারফত কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের কান ভারি করছিল, সে বিষয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছেন আলোচ্য গ্রন্থের লেখক। তাই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন এবং প্রশ্নের ভিত্তিকে মজবুত করেছেন গবেষণালব্ধ বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত দিয়ে, সে সময়ের পত্রপত্রিকার ক্লিপিং উদ্ধার করে। দেখা যাচ্ছে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের নিউইয়র্ক টাইমস-এর ১৮ এপ্রিল, ৯ মে ও ২৫ জুলাইয়ের আলোচনায় এবং ‘নিউইয়র্ক ট্রিবিউন’র ২২মে সংখ্যার আলোচনায় উৎকর্ষের দিক থেকে বসন্তকুমারের রচিত Rabindranath Tagore: The Man and His Poetry গ্রন্থখানিকে আর্নেস্ট রীজ রচিত Rabindranath Tagore: A Biographical Study এবং ইরেজ জীবনীকার বসওয়েল রচিত জীবনীগ্রন্থের চাইতেও অধিক মূল্যবান বলে মতামত প্রকাশ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বসন্তকুমার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্থায়ী বিরূপ ধারণা জন্মে- রবীন্দ্রনাথের অনাদর আর উপেক্ষাই জুটেছিল তাঁর ভাগ্যে। অপরপক্ষে E.J. Thompson- রচিত Rabindranath Tagore: His Life and Work গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে তৃপ্তি দিয়েছিল। কবি পছন্দ করেছিলেন কৃষ্ণ কৃপালনী রচিত Rabindranath Tagore: A Biography এবং কৃষ্ণা দত্ত ও অ্যান্ড্রু রবিনসন রচিত Rabindranath Tagore: The Myriad Minded Man শীর্ষক গ্রন্থ দু’খানি। আর অজিতকুমার কৃত জীবনীগ্রন্থ কবির সমাদর পেয়েছিল। (পৃ. ৩৩-৪৫)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ১৯১১ সালের ৭ই মে (২৪শে বৈশাখ) তারিখে ব্রহ্মচর্য স্কুলের শিক্ষক অজিতকুমার চক্রবর্তী (১৮৮৬-১৯১৮) কবির প্রথম জীবনীমূলক প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রবন্ধটি ১৯১২ সালে (১৩১৮ বঙ্গাব্দ) গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের একশত বছর পর আজও তা মূল্যবান ও প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত হয় সুধীজনের কাছে। উল্লেখ্য অজিত কুমার ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষক, সঙ্গীত ও অভিনয় শিল্পী, অনুবাদক ও পরিশ্রমী লেখক। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অপর তিনটি গ্রন্থ- মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, খৃষ্ট, ব্রহ্ম বিদ্যালয় এবং কাব্যপরিক্রমা। তাছাড়া শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের বহু পাঠ্যপুস্তক রচনার নেপথ্য কারিগর ছিলেন এই অজিতকুমার চক্রবর্তী। লোকচক্ষুর অন্তরালে তার কাজ হলো রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ইংরেজিতে অনুবাদ করে ইউরোপে প্রকাশ করা, যার বিস্তারিত উপস্থাপন করা হয়েছে এ গ্রন্থে। এ গ্রন্থে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে ইউরোপের প্রকাশনা হাউস ও পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়া সে সব অনুবাদ সাহিত্যের লেখক ও সম্পাদক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নাম এবং সহযোগী হিসেবে ইউরোপীয় সাহেবদের নাম মুদ্রিত হলেও অনুবাদক অজিতকুমার চক্রবর্তীর নাম উল্লিখিত হয়নি কোথাও- যা অজিতকুমারের জন্য ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মানবতাবাদী লেখক সুব্রত কুমার দাস তাই সহানুভূতির সাথে লেখেন, নিভৃতচারী এ মানুষটি ‘রবি-চ্যুত না হয়েও চোখে জলের সাগর বানিয়েছেন’ নিজের জীবনকে- নিরবে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন শান্তিনিকেতনের কোলাহল থেকে। অজিতকুমার ছিলেন ক্ষণজন্মা মানুষ, অর্থকষ্ট ও দুর্ভাগ্য কখনো তাঁর পিছু ছাড়ে নাই। অভিমান করে অথবা জীবিকার সন্ধানে ১৯১৫ সালে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতা চলে যান, সেখান থেকে যান আসামে এবং সেখানেই ১৯১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। পরে তাঁর পরিবারের জন্য শান্তিনিকেতন থেকে অনেক কিছু করা হলেও রবীন্দ্রনাথ কম-জানা অজানা গ্রন্থের লেখকের মূল সমবেদনা অজিতকুমারের জন্যই নিবেদিত হয়েছে। (পৃ. ৪৬ -৫২)

এখন প্রশ্ন হলো- রবীন্দ্রনাথের অভিযোগ বসন্তকুমার তাঁর লেখা চুরি করে, অনুমতি ছাড়া তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) রচনার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে; অজিতকুমারের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও একই ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে কি না? অবশ্য লেখক এ সম্পর্কে সরাসরি কোনো প্রশ্ন তোলেননি, কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনা পরম্পরা ও নৈতিকতার কম্পাস যেন সেই দিকেরই নির্দেশ করে।

রবীন্দ্র-গল্পগ্রন্থের প্রথম অনুবাদ করেন রজনীরঞ্জন সেন (১৮৬৭-১৯৩৫)। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের সাহিত্যিক ও আইনজীবী। তাঁর গ্রন্থের নাম Glimpses of Bengal Life (১৯১৩) – কাবুলিওয়ালা, ছুটি, পণরক্ষা, সুভা, অতিথি, শুভদৃষ্টি, কঙ্কাল, ঘাটের কথা, শাস্তি, প্রায়শ্চিত্ত, স্বর্ণমৃগ, অনধিকার প্রবেশ এবং ক্ষুধিত পাষাণ – রবীন্দ্রনাথের এই ১৩টি ছোটগল্প অনুবাদ করে এ গ্রন্থে প্রকাশ করা হয়। গ্রন্থের ভূমিকায় অনুবাদক উল্লেখ করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৯ সালে তাকে গল্পগুলো অনুবাদ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এ গ্রন্থটিই রবীন্দ্রগল্পের প্রথম ইংরেজি সংকলন। ১৯১৩ সালে চট্টগ্রামের ‘মিন্টু প্রেস’ এবং মাদ্রাজের ‘জিএ ন্যাটসন’ প্রকাশনী সংস্থা থেকে একইসাথে প্রকাশিত হয় গ্রন্থটি। সম্ভবত ঐ একই সময়ে ‘লুজাক এন্ড কোম্পানি’ নামক একটি প্রকাশনা সংস্থা লন্ডন থেকেও গ্রন্থটি প্রকাশ করে, যা প্রকাশের অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সুইডেনে নোবেল কমিটির কাছে তা উপস্থাপিত অথবা গোচরীভূত হয়ে থাকতে পারে। গ্রন্থটির সময়োপযোগী প্রকাশনার ফলে তা রবীন্দ্রনাথের কাব্যকৃতির পাশাপাশি কথাসাহিত্যিক ও গল্পকার হিসেবে তাঁর সৃজনশীলতা ও শক্তিমত্তা এবং রবীন্দ্রসাহিত্যের ব্যাপ্তি, বৈচিত্র্য ও গভীরতা অনুধাবনে পাশ্চাত্য দেশের জনসাধারণ ও নোবেল কমিটির জন্য যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। সুইডিশ একাডেমি নোবেল কমিটির সভাপতি ড. হেরাল্ড হেয়ার্ন ১৯১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর তারিখে স্টকহোমে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণেও তাই GitanjaliGardener কাব্যগ্রন্থ দু’টির পাশাপাশি প্রায় সমান গুরুত্ত্ব দিয়ে উল্লেখ করেন রজনীরঞ্জন অনূদিত Glimpses of Bengal Life গল্প সঙ্কলনটির কথা। কিন্তু চট্টগ্রাম কলেজের এ আইনের প্রভাষক রজনীরঞ্জনের ভাগ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরাগ জোটেনি কখনো, কৃতজ্ঞতা তো নয়ই।

অবশ্য প্রশান্তকুমার পাল, কৃষ্ণা দত্ত, অ্যান্ড্রু রবিনসন প্রমুখ সমালোচকের মতে রবীন্দ্রনাথের খ্যাতিমান হয়ে উঠার সম্ভাবনা বুঝতে পেরে রজনীরঞ্জন তড়িঘড়ি করে Glimpses of Bengal Life গ্রন্থটি প্রকাশ করেন, তার অনুবাদ ত্রুটিপূর্ণ। রবীন্দ্রাথের নিজের মতে His translation very inaccurate and as far as I am able to judge, his English is poor’। অপরপক্ষে প্রশান্তকুমার পালের মতে রবীন্দ্রনাথ রজনীরঞ্জনকে তাঁর গল্প অনুবাদের অনুমতি দিলেও পরে পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় গ্রন্থটির প্রকাশ তাঁকে বিব্রত করেছে। এখানে স্মরণ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, রবীন্দ্রনাথের নিজের করা গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ সম্পর্কেও ইউরোপীয়রা কখনো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেনি, বরং উল্টোটাই করেছে বেশি।

সঙ্গত কারণেই আলোচ্য গ্রন্থের লেখক মনে করেন রবীন্দ্রগল্পের প্রথম ইংরেজি সংকলন Glimpses of Bengal Life গ্রন্থের প্রণেতা রজনীরঞ্জন উপেক্ষিত হওয়ার মতো কাজ করেন নি। লেখক তাই সাহসিকতার সাথে উচ্চারণ করেন, স্মরণীয় কাজের জন্য বার বারই রজনীরঞ্জনের নাম উচ্চারিত হবে ঐতিহাসিকতার প্রয়োজনে। (পৃ. ৫৩- ৫৭)
পৃথিবী বিখ্যাত পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৯১৩ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে তাঁর নোবেল পুরস্কার বিজয়, আমেরিকা ভ্রমণ, নতুন বই প্রকাশ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করে। এ পত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদনে কবিকে আমেরিকান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান-এর সাথে তুলনা করা হয়। পাশ্চাত্য নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে কবির চিত্রা কাব্যগ্রন্থের মূল্যায়ন, হিন্দু কবির নোবেল বিজয়, তাঁকে ভারতবর্ষের প্রখ্যাত কবি ও পয়গম্বর হিসেবে আখ্যায়িত করা- প্রভৃতি বিচিত্র বিষয় ছিল সে সব প্রতিবেদনের উপজীব্য। ভারতের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী, হুইটম্যান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন- ইত্যাদি বাণী সম্বলিত রবীন্দ্রনাথের বিশাল বিশাল সাক্ষাৎকার, আমেরিকা গিয়ে কবির ১৮টি ভাষণ প্রদান, ম্যাকমিলান কোম্পানি থেকে কবির কবিতা ও গল্পের বই প্রকাশ, রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, তাঁর উপন্যাস নিয়ে আলোচনা, ইউরোপে কবির নাটকের মঞ্চায়ন- এধরনের বিচিত্র বিষয় উঠে আসে এ পত্রিকার পৃষ্ঠায়। বসন্তকুমার রায়, হেলেন বিউলিস, মাড এলান, জয়েস কিলমার, লুইস মুনসেল ফিল্ড প্রভৃতি প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গ এ সব আলোচনা ও প্রতিবেদন রচনা এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণের কাজ করেছিলেন। (পৃ. ৫৮-৬৩)

আমেরিকার আরেকটি প্রভাবশালী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন। পত্রিকাটি ১৯১৩ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর চাইতেও আরো ব্যাপকভাবে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রচারণা চালায়, আরো বহু বিচিত্র বিষয়ে সচিত্র সংবাদ, প্রতিবেদন, আলোচনা, সাক্ষাৎকার ও নিবন্ধ প্রকাশ করে। এমনকি পত্রিকাটিতে রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে ব্রিটিশ শাসন উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার সংবাদও পরিবেশিত হয়। (পৃ. ৬৪-৭০)

এ সব সংবাদ, প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার ও নিবন্ধে সে সময়ে কবির প্রতি আমেরিকান জনগণের মানসিকতা ও গণমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে সহায়তা করে। গ্রন্থকার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানিয়েছেন, এ সকল পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের কথাও রবীন্দ্র জীবনীগুলোতে নাই বললেই চলে।

রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয়বার আমেরিকা সফরে গেলে তাঁর ছ’টি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছিল। এ সব সাক্ষাৎকার আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা সৃষ্টিতে ব্যাপকভাবে সহায়ক হয়েছিল। এসব সাক্ষাৎকার ও পত্রপত্রিকায় ব্যাপক প্রচারণার ফলে আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহন করেন এবং তাঁর বই আমেরিকার বাজারে বেস্ট সেলার হয়ে ওঠে, ম্যাকমিলান কোম্পানিও তা সরবরাহ করে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। কিন্তু এ সব সাক্ষাৎকারের কথাও রবীন্দ্র জীবনীগুলোতে নাই বা উপেক্ষিত হয়েছে। (পৃ. ৭১-৭৬)

আমেরিকার মতো অস্ট্রেলিয়াতেও বাঙালি ও বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদে কবির বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সিডনি মর্নিং হেরাল্ড, রেজিস্টার, সানডে টাইমস, মর্নিং বুলেটিন, মেইল, আরগুস, এডভার্টইজার, ব্রিসবেন কুরিয়ার প্রভৃতি অস্ট্রেলিয়ান সংবাদপত্রেও বিপুল প্রচারণা পেয়েছিলেন বিশ্বকবি। কিন্তু তাঁর জীবনীগুলোতে এসব সংবাদপত্রের প্রসঙ্গ বা কবি সম্পর্কে এগুলোতে প্রকাশিত অস্ট্রেলীয় জনসাধারণের মতামত বা অনুভূতি সম্পর্কে কিছুই উল্লিখিত হয় নাই। পরিশ্রমী গবেষক সুব্রত বিপুল তথ্য এবং বিস্তারিত বর্ণনার মাধ্যমে এ অভাবের সবটাই মিটিয়েছেন তাঁর গ্রন্থে। (পৃ. ৭৭-৮০)

জানা যায় বার বার আয়োজন ও উদ্যোগ নেওয়া হলেও- তৎকালীন বিশ্ব প্রেক্ষাপট, ভারতীয় স্বাধীনতা ও ব্রিটিশবিরোধী ষড়যন্ত্রের সাথে নোবেল-জয়ী ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম জড়িয়ে আমেরিকার গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ, অষ্ট্রেলিয়াতে সে বিষয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার খবর এবং কবির শারীরিক অসুস্থতার কারণে- কবির পক্ষে শেষপর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করা হয়ে ওঠেনি। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯১৮, ১৯১৯, ১৯৩৪ এবং ১৯৩৭ ক্রিষ্টাব্দে মোট চার বার কবিকে সেদেশে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রতিবারই সফর আয়োজনে ইতিবাচক উদ্যোগ নেয়া হয়, এমনকি সে দেশের গণমাধ্যমে কবির সফরসূচি সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা হলেও শেষ পর্যন্ত তা ঘটেনি। রবীন্দ্রজীবনী গ্রন্থগুলোতে বিষয়টি অস্পষ্ট থাকায় সুব্রত কুমার দাস রবীন্দ্রনাথের অস্ট্রেলিয়া সফর সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন এ গ্রন্থে। (পৃ. ৮১-৮৪)

বিশ্বকবি নোবেল বিজয়ের আগে ও পরে মোট পাঁচবার আমেরিকা ভ্রমণ করেন। কোনো একক দেশে তাঁর ভ্রমণের এটিই সর্বোচ্চ রেকর্ড। সে দেশে ভ্রমণের সময়ে, আগে ও পরে কবিকে নিয়ে যে বিপুল আলোচনা এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটেছে এ গ্রন্থে সেই অজানা তথ্যের বিপুল সমাহার ঘটিয়েছেন সুব্রত। বিশেষ করে সুদূর আমেরিকায় প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের সংগঠিত তৎপরতা, গদর (বিদ্রোহ) পত্রিকার সম্পাদক রামচন্দ্রকে গুলি করে হত্যা, জাপান সফরকালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সম্পর্কে ও উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদী তৎপরতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিরূপ মন্তব্য, সে বিষয়ে আমেরিকা-প্রবাসী ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া, হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গ, ‘কোমাগাতা মারু’ জাহাজে আক্রমণ চালিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের ভারতীয় নাগরিক হত্যা ও সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষোভ, প্রবাসী বিপ্লবীদের সাথে কবির যোগাযোগ থাকার সংবাদ প্রকাশ এবং বিপদগ্রস্ত কবির আদালতে অভিযুক্ত হওয়া- ইত্যাদি শিহরণ জাগানোর মতো অজানা বিপুল তথ্যরাজি সুব্রতর হাত ধরে আমাদের দুয়ারে হাজির হয়েছে এ গ্রন্থের মাধ্যমে। (পৃ. ৮৫-৯৮)

রবীন্দ্রনাথ কম-জানা, অজানা গ্রন্থটির শেষ অধ্যায়ে আমেরিকার শিকাগো শহর থেকে প্রকাশিত মাসিক পোয়েট্রি পত্রিকায় রবীন্দ্রসাহিত্য, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রচিত সাহিত্য ও বাঙালি কবিদের রচনা প্রকাশ এবং সে পত্রিকার সাথে তাঁদের শতবর্ষব্যাপী যোগাযোগের অজানা বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে।

ক্ষুুদ্রাকৃতি এ গ্রন্থখানি গুরুত্বে অপরিসীম ও অসামান্য। সমকালীন সাহিত্যিক, সমালোচক, জীবনীকার ও গণমাধ্যমের সাথে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্কের এক অজানা দিকের উন্মোচন ঘটেছে গ্রন্থটিতে। বিশেষ করে সাহিত্যিক, রবীন্দ্র-গবেষক এবং সমাজতাত্ত্বিকদের জন্য গ্রন্থটি নিত্যব্যবহার্য হয়ে উঠবে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। গ্রন্থটি অঙ্গসৌষ্ঠব চিত্তাকর্ষক এবং প্রচ্ছদ অসাধারণ। তবে কোনো কোনো বিষয়ে অপূর্ণাঙ্গ তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে গ্রন্থটিতে, বেশ কিছু মুদ্রণ প্রমাদ ও তথ্যের পুনরুক্তি রয়ে গেছে এবং কোথাও কোথাও রয়েছে অপূর্ণাঙ্গ অথবা অর্থহীন বাক্যের ব্যবহার (পৃ.৬২)। অনেক সরল বিষয়কে জটিল আকারে জটিল বাক্যে প্রকাশ করার প্রবণতার ফলে কখনো কখনো সহজ বিষয়কে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অস্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। কখনো কখনো পরিবেশিত বিপুল তথ্যের ভীড় থেকে কাক্ষিত তথ্য খঁজে নেওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। বেশ কিছু শব্দের বহুব্যবহার ও অপপ্রয়োগ লক্ষ করা যায় গ্রন্থে, যেমন- শেষপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করা হয়ে ওঠেনি (পৃ. ৮৩) এবং রবীন্দ্রজীবনীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ইঙ্গিত না থাকা (পৃ. ৮৭) প্রসঙ্গে মজা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু এসব কোনো মজার বিষয় হতে পারে কি? গ্রন্থে দু’য়েকটি অপ্রচলিত অথবা একবারে নতুন শব্দ ব্যবহারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ আছে, সেজন্য লেখককে সাধুবাদ জানাই। তবে, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী বুঝাতে ‘সাক্ষাৎকারক’ শব্দটির ব্যবহার (পৃ. ৭৬) কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে (?), এখানে এ প্রশ্নটি উত্থাপন করা যেতে পারে। প্রশ্ন আরেকটি- গ্রন্থের নামকরণের মধ্যে কি কিছুটা উন্নাসিকতা বা অহমিকার লক্ষণ আছে?

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এ গ্রন্থের প্রধান প্রতিপাদ্য হলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ অনেক নিবেদিতপ্রাণ লেখক, প্রতিবেদক, জীবনীকার, রবীন্দ্র সাহিত্যের বিস্মৃতপ্রায় আলোচক ও সমালোচক- যাদের কথা আমাদের অজানা রয়ে গেছে স্বয়ং কবির কাছ থেকে অথবা তাঁর জীবনীকারদের কাছ থেকে অবহেলার শিকার হওয়ায় রবীন্দ্র-জীবনীগুলোর কোনোটাতেই তাঁদের কথা উল্লেখ না থাকার কারণে। কিন্তু গ্রন্থখানি পড়া শেষ হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেটা মনে আসে, তা হলো- কেন এমন হলো? কবি কেন তাঁর ভক্ত অনুরাগীদের কাজকে গুরুত্ব দিলেন না? তাঁর জীবনীকারকরাই বা কেন সমকালীন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন বিপুল তথ্যরাজিকে অস্বীকার বা অবহেলা করলেন? জীবনীকারেরা কি গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এমন করলেন? বিষয়গুলোকে কি তারা কম গুরুত্ব দিয়েছেন, নাকি সে যুগে আজকের মতো আধুনিক প্রযুক্তির অনুপস্থিতি অথবা ভৌগোলিক অথবা অন্য কোনো সীমাবদ্ধতার কারণে এমন ঘটেছে? কবি স্বয়ং এবং তারা সবাই কি একই ভুল করলেন? এর পেছনে কি কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে, না অন্য কোনো গুঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে? সাধারণ পাঠক হিসেবে আমরা এতদিন তো এর অনেক কিছু জানতামই না। কিন্তু এখন যখন জানতে পারলাম তখন মনের মধ্যে অতৃপ্তির একটা ঢেকুর গজ গজ করছে- লেখকও তো তাঁর কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়ে আমাদের কৌতুহল নিবৃত করতে পারতেন! কিন্তু দু’একটি বিষয় বাদে লেখকেরও কোনো ব্যাখ্যা নাই, তাই এক্ষেত্রে হতাশ হতে হলো। সবশেষে বলতে হয় অবিস্মরণীয় এক গ্রন্থ পাঠ করলাম যা মনের মনের মধ্যে অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার ক্ষুুধা বাড়িয়ে দিল, কম-জানার অতৃপ্তি সে কি আর মেটে কোনো কালে?