কবি আসাদ চৌধুরী: উলানিয়া থেকে অশোয়া

সুজিত কুসুম পাল

রুপালি তবক দেয়া পান নিয়ে  

বসে আছি জানালায় গালে হাত দিয়ে

সারারাত

তিন

দিন।

[প্রতীক্ষা]

জীবনানন্দ দাশের সেই বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া’র কবি আসাদ চৌধুরী (১৯৪৩—২০২৩) এখন আর গালে হাত দিয়ে রুপালি তবক দেয়া পান নিয়ে সারারাত জেগে থাকছেন না। যে পাখিকে তিনি তাঁর ‘ডানা-অলা বন্ধু’ বলে জানতেন, সেই পাখিরা গত ০৫ অক্টোবর ২০২৩ তাদের ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে টরন্টো শহরের আকাশটাকে বেদনাময় করে তুলেছে। এখানে, এখনো বাতাস ক্ষণে ক্ষণেই ফুঁপিয়ে উঠছে। তরঙ্গ-বোঝাই শোকার্ত লেক অন্টারিও সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে কবি তাঁর পূর্ণ শরীর নিয়ে যোগদান করেছেন মহাকালের মিলন উৎসবে। অথচ ‘তবক দেওয়া পান’ (১৯৭৫) শীর্ষক তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার গোটা শরীর কিছুতেই ঘরে আসতে চায় না, হয়তো সবটা দেহ কোনো দিন ঘরে ফেরেনি। এটা আমি আগে টের পাইনি, আর পেলেই বা কী হতো? চিকিৎসার জন্য আমি তো আর ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি না, সাহানা, তোমার কাছেই এসেছি। এবার দ্যাখো তো আমার শরীরের কিছু অংশ বাইরে কোথাও ফেলে এলাম কি না?’

কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রই ধারণ করে আছে সদ্য প্রয়াত কবির জীবনদর্শনের চূড়ান্ত বার্তা। ইটের শহরে বেড়ে ওঠা এই কবি শব্দের সাঁকো দিয়ে নিজেকে সংযুক্ত করেছেন মাটির মফস্বলের সাথে। ‘তবক দেয়া পান’-এর আড়ালে তিনি প্রকৃত পক্ষে হারানো ঐতিহ্যকেই পাত্রস্থ করেছেন। সরলপ্রাণ গ্রামীণ জনপদে অতিথিসেবা ও মঙ্গলভাবনার একটি উপকরণ হচ্ছে পান। তিনি তাঁর নিজের দাদুকে দেখেছেন রুপোর পাতলা পাত থেকে তৈরি তবক দিয়ে মোড়ানো খিলি খিলি পান খেতে। কিন্তু তবক দিয়ে মোড়ানো খিলি পান দরিদ্র জনগোষ্ঠির ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। কবিজীবনের উদ্বোধনী গ্রন্থেই এইভাবে তিনি বিলুপ্তপ্রায় অতীতের জন্যে নির্মাণ করেছেন বসতবাড়ি আগামির কালভূমে বর্তমানের কাব্যিক উপাত্ত দিয়ে। আসাদ চৌধুরীর নিজের ভাষায়, ‘তবক হচ্ছে আসলে সংস্কৃত থেকে আসা বাংলা শব্দ। তবক অর্থ স্তবক। মানে কোনো কিছুকে ঢেকে রাখা। আগের দিনে আমি দেখেছি, খুব পাতলা কাগজের মতো রুপো অথবা সোনা দিয়ে তবক থাকতো, ওটার ওপরে পান দিয়ে ভাঁজ করে দিতো। সেই লোকজ বিষয়টা মাথায় রেখে লেখা হয় ‘তবক দেয়া পান’। সরল ও লোক সংস্কৃতির গন্ধ মাখা নাম তবক।‘

আসাদ চৌধুরী হাটে বসে কবিতা না লিখলেও তাঁর কবিতায় হাটের কোলাহল ভেসে আসে; মাঠে বসে কবিতা না লিখলেও উদ্ভাসিত হয় উদাস মাঠের বিজন শোভা। পুরো গ্রামবাংলা হয়ে ওঠে উলানিয়াময় তাঁর কাব্যিক মহিমায়। ‘আমার বাবা’ কবিতায় ‘মুদির ছেলে হুমায়ুন’, ‘কাজী পাড়ার শান্তি ধোপা’, ‘মধ্য পাড়ার কানু বদ্যি’ আর ‘ত্র্যস্ত-ব্যস্ত কাগজ-অলা’-র মতো চরিত্রগুলো তাই ‘আলাপ জমায় বাড়িয়ে গলা’। কবির লেখালেখি শুরু হয় ষাটের দশকে। সাংবাদিক রনেশ দাশগুপ্তের কল্যাণে, ষাটের দশকের গোড়ার দিকে, তাঁর প্রথম কবিতা দৈনিক সংবাদের ‘সাহিত্য সাময়িকী’তে প্রকাশিত না হয়ে প্রকাশিত হয়েছিলো সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায়। প্যাট্রিস লুম্বুবার মৃত্যতে লেখা হয়েছিলো সেই কবিতাটি। কবি তখন ছাত্র।

২০০৯ সালে ঢাকার কেমব্রিয়ান কলেজে অধ্যাপক সুব্রত কুমার দাসের উদ্যোগে বিশ্ব কবিতা দিবস পালন। অতিথি ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী ও ড. ফজলুল হক সৈকত। কথা বলেন অধ্যক্ষ ড. করুণাময় গোস্বামী।

কবিতা, প্রবন্ধ, শিশু-সাহিত্য, ছড়া, রূপকথার গল্প, অনুবাদ, ইতিহাস, জীবনীরচনাসহ সাহিত্যমণ্ডলের নানান বাগান তিনি চষে বেড়িয়েছেন অত্যন্ত নিপুণতার সাথে। তবে, সব পরিচয়কে ছাড়িয়ে তাঁর কবিসত্তা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে ষাটের দশকের শ্রেষ্ঠ কবিদের আঙিনায়। তেতাল্লিশটি গ্রন্থের প্রণেতা আসাদ চৌধুরীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তবক দেওয়া পান’ (১৯৭৫), ‘বিত্ত নাই বেসাত নাই’ (১৯৭৬); ‘প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়’ (১৯৭৬); ‘জলের মধ্যে লেখাজোখা’ (১৯৮২), ‘যে পারে পারুক’ (১৯৮৩); ‘মধ্য মাঠ থেকে’ (১৯৮৪), ‘দুঃখীরা গল্প করে’ (১৯৮৭), ‘বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই’ (১৯৯৮), ‘কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি’ (২০০৩), ‘ঘরে ফেরা সোজা নয়’ (২০০৬) ইত্যাদি। শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে ‘রাজার নতুন জামা’ (ভাষান্তর, ১৯৭৯), ‘ছোট্ট রাজপুত্র’ (ভাষান্তর: ১৯৮২), ‘মিকালেঞ্জেনো’ (জীবনী, ২০০১) ও ‘সোনার খড়ম’ (২০০৬) অন্যতম।

আসাদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে সর্বোচ্চ পাঠ গ্রহণ করে অধ্যাপনা করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে (১৯৬৪—৭২)। অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। কাজ করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার তখন নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন অমর একুশের সেই কালজয়ী ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতা-সঙ্গীতের গীতিকার উলানিয়ার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, যিনি ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরীর আত্মীয়। সেই সুবাদে মুক্তিযুদ্ধকালিন প্রবাসী সরকারের এই পত্রিকায় তিনি সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুই চৌধুরী মিলে প্রবাসজীবনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ নামে তিনি একটি গদ্য অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। একদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘চরমপত্র’ খ্যাত পরিচালক ও কথক এম আর আখতার মুকুল ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা অফিসে এসে আসাদ চৌধুরীকে বলেছিলেন, ‘ওই মিয়া, চমক লাগিয়ে দিয়েছ। প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদ তোমার ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ অনুষ্ঠান শুনেছেন। চালিয়ে যাও। থামবা না।’

কবি, মুক্তিযুদ্ধ শেষে, ১৯৭৩ সালে ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। ২৬ বছর চাকরির পর প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে অবসর নেন। ভয়েস অব জার্মানির বাংলা বিভাগের বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। দৈনিক জনপদ ও পূর্বদেশ পত্রিকার সাথের তাঁর নানান পর্যায়ে সম্পৃক্ততা ছিলো। সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য অর্জন করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭) এবং একুশে পদক (২০১৩) সহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা।

কবি আসাদ চৌধুরী ২০১৮ সালে ২৭ মার্চ তারিখে ব্রাম্পটনে দিলীপ চক্রবর্তী দাদার বাসাতে যান। সাথে ছিলেন কবি দেলওয়ার এলাহী।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম। তাঁর সঞ্চালিত বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলো ছিলো অসম্ভব জনপ্রিয়। কণ্ঠে ছিলো ইন্দ্রজাল। তাঁর হাসিমাখা মুখ থেকে নিঃসৃত উচ্চারণ বাতাসের শরীরকে অতিক্রম করে শ্রোতাদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখতো অন্যরকম এক মায়াজাল পেতে। কবির অট্টহাসি অনেক সময় নিতো বাতাসে হারিয়ে যেতে। একবার তিনি আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে সাথে করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দফতরে গিয়েছিলেন। তাঁরা গিয়েছিলেন উলানিয়াকে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করার আবেদন নিয়ে। নির্ধারিত সময় ছিলো মাত্র বিশ মিনিট। শেখ হাসিনা সেদিন প্রায় সোয়া দুঘণ্টা সময় তাঁদের ঐন্দ্রজালিক বচনে আটকে ছিলেন।

জনপ্রিয় আবৃত্তিকার হিসেবে আসাদ চৌধুরী ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ ও বিদেশের আনাচে কানাচে। সদালাপী মানুষটি কথা বললে মনে হতো তিনি একজন গাল্পিক। শিশু-বৃদ্ধ, সাধারণ-অসাধারণ সবাই আটকে যেতেন তাঁর প্রীতিস্নিগ্ধ কণ্ঠজালে। পাঠ কিংবা কথা বলার আমন্ত্রণে ছুটে যেতেন নিভৃত জনপদে। কবিতা পাঠের আমন্ত্রণে ২০০০ সালে ছুটে গেছেন সুদূর অ্যামেরিকার পিট্সবার্গ শহরে। ঢাকাস্থ অ্যামেরিকান, ফরাসী, রাশান, ক্যানাডিয়ান, ব্রিটিশ, ভারতীয় এবং পাকিস্থানী দুতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় কবি ও আবৃত্তিকার। ২০০১ সালে আগরতলায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-উৎসবেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, ফরাসী,জার্মান, হিন্দি, উর্দু ও মালয়ালাম ভাষায়। কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা, ভারত ও পাকিস্তান থেকে।

২০১৯ সালে এনআরবি টেলিভিশনে সুব্রত কুমার দাস আয়োজিত পূজা স্পেশাল অনুষ্ঠানে দুর্গাপূজা নিয়ে কথা বলেন বরেণ্য কবি আসাদ চৌধুরী।

আসাদ চৌধুরীর কবিতার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হচ্ছে তাঁর কবিতার বার্তার মধ্যে যেমন ঋজুতা আছে, আছে প্রকাশের মধ্যে সাবলীলতা। ব্যঙ্গাত্মক শৈলী প্রয়োগ করে সিরিয়াস বক্তব্যকে প্রাঞ্জল ভাষায় দ্রুত পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষমতা রাখতেন তিনি। সদ্য স্বাধীন দেশে মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হলে সত্যকে তিনি ফেরারির মর্যাদা দিয়ে আত্ম-বিশ্লেষণ করেন। ‘সত্য ফেরারি’ কবিতায় তিনি জানতে চাইলেন–

কোথায় পালালো সত্য?

দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো।

গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,

টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,

নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।

এমনকি কালোবাজারেও নেই

কোথায় গেলেন সত্য?

শাসকগোষ্ঠির ব্যর্থতায় সত্য নির্বাসনে গেলেও, তিনি তাঁদের দিকে আঙুল না তুলে অসাধারণ এক ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে নিজেকেই প্রশ্ন করেছেন। যে আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে এই দেশের মানুষ আন্দোলন করেছে, আত্মত্যাগ করেছে, দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর সেই আদর্শের পথে দেশ এগুতে পারে নি। ‘শহীদদের প্রতি’ কবিতায় তিনি একই কৌশল প্রয়োগ করে ব্যর্থ রাজনীতিকদের প্রশ্ন না করে জানতে চেয়েছেন বিদেহী আত্মাদের কাছ থেকে –

তোমাদের যা বলার ছিল

বলছে কি তা বাংলাদেশ ?

প্যাট্রিস লুমুম্বা, ইলা মিত্র আর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যখন কবির কাব্যসম্ভারের অন্তর্বাসে উদ্ভাসিত হন তখন পাঠক উপলব্ধি করতে পারেন শব্দাবলী দিয়ে আসাদ চৌধুরী কীভাবে বুলেট নির্মাণ করেন। যে বুলেট পাঠকের হৃদয়ে নির্মাণ করে আত্ম-জিজ্ঞাসা ও আত্ম-সমালোচনার মৌন মিনার। ‘স্মরণের মীঢ়ে ধীরেন’ কবিতাটি তিনি রচনা করেন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানের প্রথম প্রস্তাবক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে –

দিন যায়,
দিন যেতে থাকে।
তাঁর জন্যে যত শ্রদ্ধা নিজেদের প্রতি ততখানি ঘৃণা,
কারাগার তাঁকে চেনে,
ঘাতক বুলেট তাঁকে চেনে
শুধু অকৃতজ্ঞ আমরা চিনি না।

কবি বার বার পাঠকদেরকে বিস্মৃতির জগত থেকে চেতনার সৈকতে টেনে নেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তাঁর কাব্যিক স্রোতে উজানের আবহ তৈরি করে। ইলা মিত্র এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে না পারার দায় নিয়েছেন কবি নিজেই বাঙালিদের পক্ষ থেকে তাঁর ‘ইলা মিত্র এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের প্রতি’ কবিতায় –

স্বপ্ন ছিল
এখন স্মৃতির ভার,
ব্যর্থতার ভার
কোনখানে পেতে রাখি
রাত্রির প্রণাম!

এতো ব্যর্থতার বোঝা টানাটানি করতে গিয়ে কবি কিন্তু একবারও ক্লান্তির ব্যঞ্জনা নিয়ে পাঠকের দরবারে নিজেকে উন্মোচন করেননি। অতীতের কাছে বর্তমানকে একেবারে তিনি বিকিয়ে দেননি। ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ কবিতায় তিনি নিজের অস্তিত্বকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসেননি –

আগুন ছিলো মুক্তি সেনার
স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়-
প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে
কাঁপছিলো সব-অন্যায়।

এখন এ-সব স্বপ্নকথা
দূরের শোনা গল্প,
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন আছি অল্প।

‘উলানিয়ার সেই ‘তবক দেয়া পান’-এর কবি ক্যানাডার প্রবাস জীবনে এসেও বাংলার বিলুপ্তমান লোকসংস্কৃতির জন্যে তাঁর উৎকণ্ঠার কথা প্রকাশ করেছেন। বইয়ের পাঠক কমে যাওয়ায় তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘সমকাল’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক  প্রবন্ধে তিনি লিখেন, ‘সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যদি বলি, গ্রামাঞ্চলে যাত্রাপালা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। কবিগান তো হয়ই না। নাটক করতে গেলে মৌলবাদীদের অনুমতি নিতে হয়। এসব আমি শুনেছি; নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। গানবাজনা হলে হারমোনিয়াম কেড়ে নিয়ে যায়। এ রকম ঘটনা ঘটছে। এগুলো দিনের পর দিন সহ্য করলে যা হয়; আমার মনে হয়, অপসংস্কৃতি নিজেই তার জায়গাটি করে নেয়। … ফেব্রুয়ারি এলে বারবার মনে পড়ে দ্বি-জাতিতত্ত্বের কথা। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কথা। নেহরু-জিন্নাহ দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করলেন। এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। বাংলাও ভাগ করেছেন তাঁরা। পাঞ্জাবও ভেঙেছেন। যেটি লর্ড কার্জন করেননি, কিন্তু তাঁরা করেছেন সেটি। সেই ভাগাভাগি, ভাঙাটা দিনের পর দিন আরও দৃঢ় হয়েছে। … সাম্প্রদায়িকতা, দ্বি-জাতিতত্ত্ব, মৌলবাদের ভিত্তিতে যে দেশের জন্ম; ভাষা আন্দোলন সেখানে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করেছে ভাষা আন্দোলন। বর্তমান পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সেখান থেকে আমরা সরে যাচ্ছি। সম্প্রতি আমার নাতনির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ছিলাম। কয়টি বাংলা গান তারা গেয়েছে। বাংলা গান যা গেয়েছে, তা আবার ব্যান্ডের সঙ্গে মিলে। স্বাভাবিক বাংলা, লোকগীতি দেখলাম না। … মানুষের পড়ার অভ্যাস কমে গেছে। একদমই কমে গেছে। এমনকি লেখকরা দুঃখ করে বলেন, বই উপহার দেওয়ার পর ওভাবেই রেখে দেওয়া হয়। যাঁকে বই উপহার দেওয়া হয়, তিনি একটি লাইনও পড়ে দেখেন না।‘

বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরুন নবী রচিত ‘জন্ম ঝড়ের বাংলাদেশ’ গ্রন্থ নিয়ে ২০১৭ সালে টরন্টোতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য প্রদান করছেন কবি আসাদ চৌধুরী।

‘মানুষের বই কেনার অভ্যাস আগের চেয়ে কমে গেছে- এটা কল্পনাও করতে পারি না। যদিও বইয়ের মান ও উৎপাদন দুটোই অনেক ভালো। তবে পয়সাওয়ালাদের নিজেদের অর্থে প্রকাশিত বই নিয়ে সংশয় তো থেকেই যায়। … ভাষা ও সংস্কৃতির চরম দুর্দিন যাচ্ছে। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক মুসলমানদের পিছিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলেছিলেন, মুসলমানরা আধুনিক বাংলা অনেক পরে গ্রহণ করেছে। অথচ কাষ্ট হিন্দুদের চেয়ে বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক নিকটতম ছিল। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তাই। এখন আর গ্রামাঞ্চলে যাত্রা হয় না, কবিগান হয় না। মেয়েরা নাচতে পারে না।‘ [২৮ মার্চ ২০২২ ‘সমকাল’]

তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ঘরে ফেরা সোজা নয়’ (২০০৬)। দ্য ডেইলি স্টার (০৪ মে ২০২২) পত্রিকা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ আপনার ‘ঘরে ফেরা সোজা নয়’ নামে একটা বই আছে। আসলেই কি ঘরে ফেরা সহজ না?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘অবশ্যই তা সহজ না। একবার বাড়ি থেকে দূরে গেলে আর সহজে বাড়ি ফেরা যায় না। … এতে ফিরতে পদে পদে বাঁধা থাকে, চাইলেই যাওয়া যায় না। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বলছি, বাড়ি সহজে ফেরা যায় না।‘ সত্যি তিনি আর ঘরে ফিরতে পারলেন না। কী অসাধারণ ‘পোয়েটিক প্রফেসি’! সন্তানের ঘর থেকে গিয়ে উঠলেন অশোয়া হাসপাতালে। সেই উলানিয়া থেকে অশোয়া। ‘গোটা শরীর’ নিয়ে তিনি থেকে গেলেন ঘাসের চাদরে ঢাকা মৃত্তিকার বিছানায়। ‘আমার গোটা শরীর কিছুতেই ঘরে আসতে চায় না, হয়তো সবটা দেহ কোনো দিন ঘরে ফেরেনি।‘