কথাসাহিত্য বিবেচনায় ঘরোয়া মেজাজ

ফজলুল হক সৈকত

বিশ শতকে কথাসাহিত্যের বিষয় ও পরিসর বিস্তৃত হয়েছে বিচিত্র মাত্রায়। বিবিধ নতুন অনুষঙ্গ এবং প্রযুক্তি কথাসাহিত্যের গতিমুখ আলোকিত করেছে যাদুবাস্তবতা তেমনি এক চমকপ্রদ অনুষঙ্গ ও শিল্প প্রকৌশল। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা ভাষার কথাকারগণও বহুধা ভাবনায় কথাসাহিত্যের ভুবন সমৃদ্ধ করে চলেছেন। চিন্তা ও পরিসর প্রসারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কথাসাহিত্য বিচারে এবং মূল্যায়নেও যোগ হয়েছে অপরিচিত সব দৃষ্টিভঙ্গি। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (জ. ১৯২৮)-এর One Hundred Years of Solitude (নিঃসঙ্গতার এক শ’ বছর; রচনা ১৯৬৫, প্রকাশ ১৯৬৭) গ্রন্থটি ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হবার পর বিশ্বব্যাপী যাদুবাস্তবতার চিন্তা ও পাঠ ব্যাপকতর হতে থাকে। বাংলা সাহিত্যেও এ প্রবণতা প্রভাব ফেলে পরিমিত পরিসরে। আর গবেষক-অধ্যাপকদের অনুসন্ধানী দৃষ্টিও অনিবার্যরূপেই নিবদ্ধ হতে থকে এ প্রযুক্তি অন্বেষা ও বিশ্লেষণের তাগিদে।

নিরলস গবেষক সুব্রত কুমার দাসের ‘বাংলা কথাসাহিত্য: যাদুবাস্তবতা এবং অন্যান্য’ (ফেব্রুয়ারি ২০০২) গ্রন্থটি আমাদের দেশে কথাসাহিত্য বিশ্লেষণের বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যতিক্রমী ও আকর্ষণীয় সংযোজন। গ্রন্থটির শিরোনামে যাদুবাস্তবতা প্রসঙ্গ প্রাধান্য পেলেও দেখা যায় য়োলোটি ক্রমিকের আলোচনাসূচীতে মাত্র তিনটিতে যাদুবাস্তবতা বিষয়ক চিন্তাপ্রকাশ স্থান পেয়েছে। অবশ্য লেখক ভূমিকায় ‘আভাস’ দিয়েছেন এ রকম: কৃত্যটি দীর্ঘ সময়ের। তাই আলোচনাগুলোর ধাঁচ, গভীরতা ও বিশ্লেষণও বহুধা।

প্রথমত দু’টি দিক থেকে সুব্রত কুমার দাসের এ গ্রন্থটি স্থায়িত্বের প্রশ্নে স্থিতধী। এক. পরিচিত লেখকের পাশাপাশি অপরিচিত (প্রায় অনালোচিত) লেখকদের কথাসাহিত্য আলোচনার সারিতে নিয়ে আসা। দুই. দুই বাংলার কথাশিল্পীদের (কতিপয়) গ্রন্ত সঙ্কলনে বিবেচনায় রাখা। বর্তমানে বাংলাদেশের সাহিত্য বা ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য অনেক মাত্রায় ‘বাংলা সাহিত্য’ হিসাবে বিবেচিত। এ দেশের অনেক অসাবধানী গবেষক-আলোচক কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যকে ‘ভিনদেশী সাহিত্য’ ভাবতে চেষ্টা করেন- ভূখণ্ডগত ভিন্নতার কারণে। সুব্রত কুমার মূল প্রতিপাদ্যে না আনলেও কথাসাহিত্য বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যের পরিচিতি ও স্বরূপকে ভোলেন নি, সেটি আশার কথা। ‘বাংলা কথাসাহিত্য: যাদুবাস্তবতা ও অন্যান্য’ গ্রন্থে লেখকের আলোচনা তিনটি পরিচয়সূত্রে বিন্যস্ত- দলিল বা ইতিহাস, প্রবণতা ও প্রকরণ এবং যাদুবাস্তবতা। প্রথম পর্যায়ের রচনাগুলোর শিরোনাম হলো- ‘অমিয় ভূষণ মজুমদারের উপন্যাসের ইতিহাস’, ‘ননী ভৌমিকের ধূলোমাটি: স্বদেশী যুগের রাজনৈতিক দলিল’, ‘কাঞ্চনগ্রাম: বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস’, ‘বাঙালির আত্মানুসন্ধানের ঔপন্যাসিক দলিল’। দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত আলোচনাগুলো যথাক্রমে- ‘না-প্রচলিত ভাষায় বাংলা কথাসাহিত্য ও কমলকুমার মজুমদার’, ‘গুণময় মান্নার লখীন্দর দিগার’, ‘কথাসাহিত্যিক অসীম রায়’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ: ইতিহাস, লোককথা ও মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস’, ‘জীবনীমূলক উপন্যাসের রূপকার হাসনাত আবদুল হাই’, ‘মাহমুদুল হকের উপন্যাস’, ‘শৈলী ও বিষয়’, ‘ঔপন্যাসিক আহমদ ছফার পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গ পূরাণ’, ‘হুমায়ুন আজাদের প্রথম দু’টি উপন্যাস’, ‘সেলিনা হোসেনের গায়ত্রী সন্ধ্যা’, আর যাদুবাস্তবতা পর্বের প্রবন্ধ তিনটি হলো- ‘শহীদুল জহিরের উপন্যাস: একটি গদ্য সমীক্ষা’, ‘নাসরিন জাহানের উপন্যাস: স্বপ্নে বাস্তব ও বাস্তবে যাদু’ এবং ‘যাদুবাস্তবতা ও বাংলাদেশের উপন্যাস’।

সুব্রত কুমার দাসের গদ্যের বৈশিষ্ট্য হলো, সাহিত্যিক ভাষাকে মান্য করেই নিজের ঢঙে বলে যাওয়া। তাঁর এ অনায়াসপাঠ্য বয়ন-কৌশল কথাসাহিত্যের কৌতুহলী পাঠক ও গবেষককে আকর্ষণ করে। প্রচলিত অধ্যাপকীয় ভাবগম্ভীর ভাষা সৌকর্ষে লেখেন না সুব্রত। তিনি পাঠ প্রতিক্রিয়া সহজ, সকলের বোধগম্য ভাষায় প্রকাশ করার পক্ষপাতী। কোন কোন আলোচনায় যদিও তিনি ‘উদ্ধৃতিসমৃদ্ধ’ প্রবণতার ছাপ রেখেছেন, তবু সার্বিক বিবেচনায় তাঁর সাহিত্য মূল্যায়ন-কৌশল চমকপ্রদ। কথাসাহিত্য নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করতে গিয়ে সুব্রত দাস ফেঁদে বসেন গল্প কাহিনীর আবহ ও মেজাজ। সুব্রত কুমার দাসের গদ্য ভাষা যে কতটা সাবলীল তা অনুধাবনের জন্য আমরা কয়েকটি অংশ এখানে উদ্ধৃতি করছি: ১. অসীম রায়ের কথাসাহিত্য সম্পর্কে তিনি লিখেছেন- ‘অসীম রায়ে উপন্যাসের একটি প্রধান এবং উজ্জ্বলতম বৈশিষ্ট্য আত্মজীবনীমূলক উপাদানের ব্যবহার। শুধু উপন্যাসেই নয় তাঁর গল্পগুলোতেও এ বিষয় বড় বেশি স্পষ্ট। যদিও অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার, আত্মজীবনীমূলক উপাদান ব্যবহারে অসীম যেমনভাবে সচেতন তেমনিভাবে সেগুলো যাতে সাহিত্য না হয়ে শুধুমাত্র সত্য ঘটনার বয়ান হয় সে ব্যাপারেও তিনি বিশেষ মনোযোগী। কখনও কখনও এমন লক্ষণীয় যে, তাঁর ব্যক্তিজীবনের একই উপাদান ভিন্ন ভিন্নভাবে তাঁর উপন্যাসে চলে আসে।’ (পৃ ৬১)

২. ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন- কিন্তু গায়ত্রী সন্ধ্যা কি তারপরও একটি রাজনৈতিক উপন্যাস? হয়ত কোথাও কোথাও রাজনৈতিক ইতিহাসের বিবরণাদি বড় বেশি সরাসরি, কিন্তু তা প্রয়োজনাতিরিক্ত নয় তা তো ঠিক। আর রাজনীতির সমান্তরালে গায়ত্রী সন্ধ্যা তো মানুষকেই চিত্রিত করেছে। আলী আহমদ নিজে, পুষ্পিতার সাথে তার সম্পর্ক, জুলেখার জন্য তার গোপন আকাক্সক্ষা, হেডমাস্টার নসরুল্লাহ ও তাঁর পরিবার, মফিজুল, অহি, বুলু দাস, প্রদীপ্ত-মঞ্জুলিকা কাহিনী, বন্যা ও প্রতীকের আসা-যাওয়া, নজীব-নাসিম এপিসোড ইত্যাদি সবকিছুর ভিতর দিয়ে মানুষের কাহিনীই বিবৃত হয়েছে এ উপন্যাসে। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রতীককে যখন আমরা গেরিলা আক্রমণে দেখতে পাই তখন রাজনীতি নয় বরং মানুষের তীব্র জীবনবোধই আমাদের প্রবুদ্ধ করে। যে জীবনবোধের মৃত্যু আমরা বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে আলী আহমদের অপহরণের ভিতর বা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনার ভিতর উপলব্ধি করি।’ (পৃ ১১১-১২)

৩. শহীদুল জহিরের সাফল্য বর্ণনা করতে গিয়ে সুব্রত লিখেছেন- ‘কথাসাহিত্যে যাদুবাস্তবতার যে ধারাটি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে ভীষণভাবে উপস্থিত তার ছায়া শহীদুল জহিরে রয়েছে-, হ্যাঁ, অনেকখানি এবং শুধু যে কারণেই শহীদুল জহিরের ভাগ্যে প্রশংসা কম জুটবে তা আমি মানতে নারাজ। উপস্থাপন অর্থাৎ উপন্যাসের কর্মগত দিক থেকে বাংলা সাহিত্যে চিরকালই বিদেশী নতুন নতুন ধারায় আত্মস্থ হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত সেখানে এ ব্যাপারটিতে উনিশ-বিশ ব্যতীত অন্য কিছু তো ঘটেনি। এবং শহীদুল জহির আমাদের সবার বাহবা পাবেন এ জন্যই যে সম্পূর্ণ দেশীয় পরিপ্রেক্ষিতকে তিনি তাঁর নিজের ভাষায় উপন্যাসে গ্রন্থবদ্ধ করতে পেরেছেন। যাদুবাস্তব ধারার শৈলীগত বৈশিষ্ট্যের ছায়া তাঁর দুটো উপন্যাসে থাকলেও তিনি সক্ষম পাঠককে তাঁর বিষয়ের গভীরে নিয়ে যেতে, পাঠকের মননে নতুন আলো ফেলতে এবং চেতনাকে আরও বেশি চকচকে করতে।’ (পৃ. ১১৯-২০)

বর্তমান গ্রন্থে বাক্যবন্ধ এবং বাক্যপ্রকৌশলে দুর্বলতা লক্ষণীয়। সুব্রত কুমার কখনও কখনও দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর এবং সূত্রহীন-শিথিল বাক্য প্রয়োগ করেছেন। যদিও বাক্যের গঠন ও প্রকৌশল এখন ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিসরে পরিবর্তিত। এ পরিবর্তনের ফলে বাক্যের আকার এবং প্রকৃতি সহজ হয়েছে। বাক্যের সেই প্রচলিত জটিলতা আর নিয়ম-সর্বস্বতা নেই। কবি মাসুদ খানের ভাষায়- কিছুকাল আগে, বহুবাহুল্য-বাচনে আন্দোলিত ছিল রাত্রির আকাশ
অথচ এখন কোন কথা নেই।
এইবার, জগতে জগতে, বিশ্বজুড়ে,
শুধুমাত্র ক্রিয়াপদে
শুধু ক্রিয়াকৌশলে নিষ্পন্ন হচ্ছে এক একটি বাক্য।
(বৃষ্টি-৪: নদীক’লে করি বাস)
সুব্রত কুমার দাসের আলোচনা থেকে উদাহরণ উপস্থিত করলে তাঁর বাক্য গঠন কৌশল সম্পর্কে পাঠকের ধারণা স্পষ্ট হবে-
ক. ‘বিশেষভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখব লোক যখন মহিউদ্দিন, তাঁর বংশ, জলেশ্বরী, তাঁর ইতিহাস ইত্যাদিতে পরিক্রমণ করেন তখন সে সুদূর সময়ে থেকে এগিয়ে ভবিষ্যতের বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড সময়কে তাঁর বিবরণে আশ্রয় দেন, যা বাংলা উপন্যাসে বিশেষ অভিনবত্বের দাবিদার।’ (পৃ. ৭৫), খ. ‘যদি প্রশ্ন ওঠে সে রাতে পূর্ণিমা ছিল উপন্যাসে শহীদুল জহির আসলে কী সৃষ্টি করতে চেয়েছেন তাহলে উত্তরের অনেকখানি কাছাকাছি আমরা চলে যেতে পারব যদি বলি, গ্রামীণ লোকায়ত এক সমাজের চিত্র।’ (পৃ. ১১৫), গ. ‘এতে করে স্মৃতি থেকে আসা ওদের দু’জনের পরস্পরের প্রতি অনুভূতি এবং ভাবনাকে যেমন আমরা অনুপুঙ্খে দেখার সুযোগ পাই, সাথে সাথে আরও লাভবান হই এ কারণে যে জাহিদ বিষয়ক আখ্যানটির বিরাট একটি অংশ গ্রামের পরিবেশে আশ্রিত হওয়ায় গ্রামের মানুষের সংস্কার, চেতনা, ভাবনা, বেদনা, হতাশাকেও আমরা পেতে থাকি যা শহরে পরিবেশে স্থাপিত নিশির আখ্যানটির সাথে একটি প্রাতঃকাল উপহার দেয়।’ (পৃ. ১৩০)- এসব বাক্যকে ভেঙে ভেঙে লিখলে কিংবা যথাযথভাবে বিরামচিহ্নের ব্যবহার করলে আলোচনা আরও প্রাণবন্ত হতে পারত।

‘বাংলা কথাসাহিত্য: যাদুবাস্তবতা এবং অন্যান্য’ গ্রন্থের বিশিষ্টতা তথ্যের প্রাচুর্যতায়, বিষয় নির্বাচনের দৃষ্টিতে। আলোচনার গভীরতা-নিবিড়তার চেয়ে বেশিরভাগ অধ্যায়েই ‘সন-তারিখ নিয়ে… বকবকানি’ (লেখকের ভাষায়, পৃ. ৩১) স্থান পেয়েছে। অবশ্য এর গুরুত্বও কোন অংশেই কম নয়। কেননা লেখককে তাঁর সৃষ্টিকর্মকে বুঝতে হলে সময়-পরিপ্রেক্ষিত জানা অত্যন্ত জরুরী। সুব্রত বোধ করি সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছেন। বিশেষ করে এ গ্রন্থে যে সকল কম আলোচিত লেখকের কথাসাহিত্য বিশ্লেষিত হয়েছে, তাঁদের পাঠকদের জন্য তা দরকারী। সুব্রত কুমার দাস অনলস লেখক, অনায়াস লেখক। তিনি পড়েন, বোঝার চেষ্টা করেন, চিন্তা করেন এবং লেখেন। এ ক্রমপর্যায়গুলো ঘটতে থাকে কম সময়ের ব্যবধানে (সম্ভবত)। তাই তাঁর বলবার ভঙ্গিটি ভিন্ন-ঘরোয়া। ‘বাংলা কথাসাহিত্য: যাদুবাস্তবতা এবং অন্যান্য’ গ্রন্থটি প্রসঙ্গে এ বিবেচনাগুলো বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

বাংলা কথাসাহিত্য গবেষণায় ‘বাংলা কথাসাহিত্য: যাদুবাস্তবতা ও অন্যান্য’ একটি উজ্জ্বল প্রয়াস। কথাসাহিত্যের পাঠক-গবেষকদের কাছে এ গ্রন্থটি সমাদৃত হবেÑ এ কথাটুকু বোধ করি জোরের সঙ্গেই বলা যায়।

‘বাংলা কথাসাহিত্য: যাদুবাস্তবতা ও অন্যান্য’, সুব্রত কুমার দাস, প্রকাশকাল: ফেব্র“য়ারি ২০০২, ঐতিহ্য, ঢাকা, মূল্য: একশত ত্রিশ টাকা।

জনকণ্ঠ ৫ ডিসেম্বর ২০০৩