কণ্ঠশিল্পী রঙ্গলাল দেব চৌধুরী: একটি ভূমিকা
প্রণবেশ পোদ্দার
স্বর্গীয় রাসবিহারী দেব চৌধুরী ও স্বর্গীয়া সুবাসিনী দেব চৌধুরীর ঘর আলো করে এক শুভক্ষণে রঙ্গলাল দেব চৌধুরী পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করেন। ক্যালেন্ডারের তারিখ মোতাবেক সেই শুভক্ষণটি ১৯৩৬ সালের ৭ জুলাই। জন্মসূত্রে রঙ্গলাল দেব মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার অধিবাসী। তাঁর পিতামহ রাধানাথ দেব চৌধুরী ছিলেন প্রভাবশালী ও প্রতিপত্তির অধিকারী এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। ১৯৪৭ সালের পূর্বে অবিভক্ত বাংলা ও আসাম প্রদেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে খ্যাতি ছিল তাঁর।
পিতা ও পিতামহ সূত্রে প্রাপ্ত গ্রামোফোন রেকর্ড বিক্রির প্রতিষ্ঠানে রঙ্গলাল দেব চৌধুরী সময় কাটাতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শিল্পীর গান তাঁকে অনুপ্রাণিত করে, স্বপ্ন দেখতে শেখায় গানের শিল্পী হবার। শুরু থেকেই লোকসংগীত তাঁকে আকৃষ্ট করে।
আব্দুল হালিম চৌধুরীর গান “আমার প্রাণ বন্ধুয়া কই লুকালো ওগো ললিতে” রঙ্গলাল দেব চৌধুরীকে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করে গানের চর্চায় ব্যস্ত জীবন কাটাতে। কিন্তু দেব চৌধুরীর একান্নবর্তী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত থেকে বয়োজ্যেষ্ঠদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পাননি কখনও বরং প্রতিবন্ধকতা পেয়েছেন অনেক। সেই সময় তিনি দুই বন্ধু গংগেশ দেবরায় ও সমতুল কুমার বর্ধনের সহায়তায় গানের চর্চা শুরু করেন। প্রখ্যাত বেহালাবাদক প্রয়াত দ্বারিকা মোহনের কাছেই তাঁর গানের শিক্ষার হাতে খড়ি। পারিবারিক প্রতিকূলতার পরও বন্ধুদ্বয়ের সহায়তায় সংগীতচর্চার অনুশীলন অব্যাহত রাখেন একান্তই মনের তাগিদে।
পঞ্চাশের দশকের খ্যাতিমান পল্লীগীতি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ মৌলভীবাজারে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য। সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই আব্বাসউদ্দীনের অনুরোধে শিল্পী রঙ্গলাল দেব চৌধুরী প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সংগীত পরিবেশন করেন এবং এলাকাবাসীর কাছে সুপরিচিত হন। এরপর ১৯৬০-এর দশকে কোন এক সময় ঢাকায় পাড়ি জমান পরিবারের সবার অগোচরে। পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরেই এফডিসি’র স্টুডিও ম্যানেজার নাজীরউদ্দীন চৌধুরীর (মধু মিয়া) বাসায় আশ্রয় নেন। পরবর্তীকালে নাজিরউদ্দীন চৌধুরী ও রেজাআলীর সহযোগিতায় ঢাকায় রেডিওতে অডিশন দেন। সেই সময় শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ মহিদুল হকের সাহচর্যে নতুন উদ্দীপনায় গানের চর্চা শুরু করেন এবং সুবল দাসের কাছেও গানের তালিম গ্রহণ করেন। ঘটনা প্রবাহে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লন্ডনপ্রবাসী মাহমুদ হোসেন চিত্রনির্মাণকল্পে ঢাকায় এসে পাড়ি জমালে রঙ্গলাল দেব চৌধুরীর সান্নিধ্য লাভ করেন। এক পর্যায়ে আন্দোলনের উদ্দামতায় উদ্বেলিত হয়ে মাহমুদ হোসেন দেশের গান রচনায় উদ্বুদ্ধ হন এবং দেব চৌধুরী, প্রবাল চৌধুরী, উমা চৌধুরী, সৈয়দ আনোয়ার মুফতিকে নিয়ে হোটেল আগ্রাবাদের কনফারেন্স রুমে নিয়মিতভাবে গানের চর্চা শুরু করেন। ঐ সময়ে রচিত আটটি গান রেকর্ড করা হয় পরবর্তীকালে ব্যবহারের জন্য। দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের সেই স্থানীয় মুহূর্তগুলোর সাক্ষী হয়ে আছেন টরন্টো প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম (চৌধুরী)। এসব কথা বিভিন্ন আড্ডায় উল্লেখ করেন রঙ্গলাল দেব চৌধুরী নিজে।
স্বাধীনতার যুদ্ধের বহ্নিশিখায় সারা বাংলাদেশ যখন জ্বলছিল, দেশ যখন ভয়াবহতায় প্রকম্পিত সেই মুহূর্তে তিনি ভারতে আশ্রিত হন এবং বন্ধুবর পিযূষের সহায়তায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অফিস খুঁজে পেয়ে আবার আপন ভুবন ফিরে পান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর প্রথম কোরাস গান ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল…।’ সমর দাসের সুরে রচিত এই গানটি স্বাধীনতাকামী সকল বাঙালিকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছিল।
অসুস্থতার কারণে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কর্মরত অবস্থায় গানে কণ্ঠ প্রদান তেমন আর হয়ে উঠেনি তাঁর। কিন্তু তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখেন গানের প্লানিং ও টেকনিক্যাল কাজে সহায়তা প্রদানে। গণঅভ্যুত্থান, অসহযোগ আন্দোলন ও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তিনি বিশেষভাবে স্মরণ করেন মাহমুদ হোসেনকে। তাঁর স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে সে নাম।
মুক্ত স্বাধীন দেশে ফিরে এসে সহযোগী মুখ্য সংগীত পরিচালক হিসেবে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেন এবং দীর্ঘসময় ধরে আঞ্চলিক, আধুনিক ও হাছন রাজার গান পরিবেশন ও পরিকল্পনা কাজে নিবেদিত ছিলেন। ১৯৯০ সালে তিনি সিলেট বেতার কেন্দ্রে মুখ্য সংগীত পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।
১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর প্রাপ্ত হলেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সিলেট বেতার কেন্দ্রেই চাকরিরত ছিলেন। তাঁর দীর্ঘ সংগীত জীবনের পদচারণায় তিনি শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ হিসেবে পেয়েছেন সমর দাস ও মোহন লাল দাসকে। গীতিকার হিসাবে যাঁরা তাঁর হৃদয়ে আসন নিয়ে আছেন তারা হলেন – ফিরোজ উদ্দীন আহম্মেদ, সেলিম আহম্মেদ, নুরুজ্জামান মুনির, সালমা আহম্মেদ, বিদ্যুৎ কর এবং সামসুল আলম সেলিম।
সমসাময়িক শিল্পী হিসেবে তিনি আব্দুল জব্বার ও মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। নজরুল গীতি ও শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী এবং মূলত শিক্ষক হিসেবে সুধীন দাসের নাম তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন বিভিন্ন আলোচনায়।
ওয়াহিদুর রহমানের কণ্ঠে নুরুজ্জামানের লেখা “আগের মত আর কেউ ভালোবাসতে পারে না, আগের মত কেউ তাজমহল গড়তে পারে না” গানটিই ছিল রঙ্গলাল দেব চৌধুরীর সর্বশেষ প্রডাকশন।
২০০৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কানাডা-প্রবাসী মেয়ের আমন্ত্রণে ক্যানাডায় আগমন করেন এবং বর্তমানে কানাডার টরন্টো নগরীতে সস্ত্রীক অবস্থান করছেন।
আলাপচারিতায় তিনি প্রায়শঃই বলেন, স্বাধীনতা প্রাপ্তি আমাদের আশাপ্রদ হয়নি। যে আদর্শ, চিন্তা ও চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়েছিল আজ দীর্ঘ ৪৫ বছর পরও আমরা স্বাধীনতার প্রাপ্তির মূল আদর্শ ও চেতনা থেকে যোজন যোজন দূরে রয়েছি বলে তিনি কষ্ট বোধ করেন।
তাঁর জীবদ্দশায় চেতনায় ও আদর্শে জাগরূক সোনার বাংলাদেশ তিনি দেখতে চাইতেন। সংগীত পরিমণ্ডেলের শূন্যতা প্রবাস জীবনে তাঁকে পীড়া দিত। তিনি ব্যস্ত সময় কাটাতে চাইতেন সংগীতচর্চা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে।
২০১৭ সালে কানাডার সাহিত্য সংগঠন বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি) থেকে তাঁর প্রথম বই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পেছনের কথা’ প্রকাশিত হয়।
২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর রঙ্গলাল দেব চৌধুরী ৮২ বছর বয়সে টরন্টোতে প্রয়াত হন।