এক পাঠকের দুটি কথা

দেলওয়ার এলাহী

সুব্রত কুমার দাস রচিত শ্রমলব্ধ ‘রবীন্দ্রনাথ: কম-জানা অজানা’ গ্রন্থখানি পাঠ করার সুযোগ আমার হয়েছে। ১০৪ পৃষ্ঠার বইটি পাঠ করে আমরা জানতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে এক বাঙালি কবিকে নিয়ে তৎকালীন পশ্চিমা বিশ্বের সারস্বত সমাজের আগ্রহ ও ভাবনা। মানব হৃদয়ের অলঙ্ঘনীয় বোধের নিপুণ রূপকার হিসেবে বাঙালি তো বটেই অপরাপর সংস্কৃতির মহৎ সৃষ্টির প্রতি আগ্রহ আছে এ রকম যে কোন ভাষাভাষীর রসিক জনের কাছেও এক বিস্ময় হিসেবে বিবেচিত হবেন বলে আমার ধারণা।

রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে বারোটি প্রবন্ধের এই সংকলন গ্রন্থটি। কিন্তু প্রতিটি প্রবন্ধই স্বতন্ত্রস্বাদে আলাদা। প্রথম প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার নিয়ে। ইংল্যান্ডে তখন রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচারের সদস্যরা নোবেল কমিটিতে যোগ্য কবি-সাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কার বিবেচনার জন্য সুইডিশ একাডেমির নোবেল কমিটিতে প্রস্তাব পেশ করতেন। ইংল্যান্ডে এই নিয়ম হয়তো এখনো আছে। এই প্রবন্ধে জানতে পারি তৎকালীন রয়্যাল সোসাইটির সাতানব্বই জন সদস্য পালাক্রমে বিভিন্ন বছরে টমাস হার্ডির নাম নোবেল কমিটিতে প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সোসাইটির অন্য সদস্য স্টার্জ মূর (T. Sturge Moore) প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। সুইডিশ কবি কার্ল গুস্তাফ হেইডেন স্টামও রবীন্দ্রনাথের নামে প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর নামটি পুরস্কার প্রস্তাব তালিকায় থাকা স্বত্বেও।
দার্শনিক হিসেবে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন যে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তা জানতাম, কিন্তু তাঁর নাম যে নোবেল কমিটির কাছে পুরস্কারের জন্য প্রস্তাবিত হয়েছিল তা জানতাম না। সর্বপল্লীকে সাহিত্যিক হিসেবে পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব হয়েছিল না শান্তির জন্য তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। একই প্রবন্ধে অপরাপর ভারতীয়দের নোবেল কমিটির কাছে প্রস্তাব যাওয়া নামগুলো জেনেও তাঁদের প্রতি আগ্রহ জেগেছে। হতবাক হয়েছি একথা জেনে যে, পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ একটি যোগ্য নাম পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব পাঠাতে পারতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নোবেল কমিটির কাছে পাঠানোর মতো ১৯১৪ সাল থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত একটি নামও পেলেন না!

তবু রবীন্দ্রনাথই আমার প্রাণে সুর দিয়েছেন, বোধে মানবিকতা দিয়েছেন, বিবেচনায় পরমত সহিষ্ণুতা শিখিয়েছেন, ভালোবাসায় অকৃপণ করেছেন; সর্বোপরি অচেনা আমার কাছে আমাকেই চিনিয়েছেন এবং সেটাই সবচেয়ে বড়।
বাঙালি মাত্রেই বোধকরি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের প্রতি আগ্রহ স্বাভাবিক। আমারও আছে।
তাই ইতি-উতি তাঁর সম্পর্কে যা পেয়েছি চোখ বুলিয়ে গিয়েছি। ‘রবীন্দ্রনাথ: কম-জানা অজানা’ গ্রন্থখানি পাঠ করে আমি আরেক অচেনা দরোজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা তাঁর সফরকালীন সময়ে পত্রপত্রিকায় খবরের পাশাপাশি তাঁকে নিয়ে আলোচনা প্রবন্ধ-নিবন্ধ সবই জানা যাচ্ছে এই গ্রন্থখানির মাধ্যমে। বিস্ময়করভাবে আরও জানতে পেরেছি, তৎকালীন বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক পণ্ডিতকে: বিনয়কুমার সরকার – এক নির্মোহ পণ্ডিত। রবীন্দ্রসৃষ্টি সাগরে অবাধ অবগাহন করেছেন আবার সেই অতল সাগরে ডুব দিয়ে কুড়িয়ে আনা রবীন্দ্রবোধ সারাবিশ্বের পাঠকের কাছে তুলে ধরছেন। যে মুগ্ধতা নিয়ে বিনয়কুমার সরকার রবীন্দ্রনাথকে স্বাগত জানিয়েছেন, ষাটোর্ধ্ব সেই রবীন্দ্রনাথকেই বিনয়কুমার কী নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে সমালোচনা করছেন ভাবলে বুঝতে বাকি থাকে না তাঁর জ্ঞানের পরিধি কী মহিমায় ভাস্বর। যে কোন তুলনামূলক বিচারে তুল্য ব্যক্তির কাজ এবং ব্যক্তিকে জানতে হয়। কতকুটু জানলে বিনয়কুমার সরকার গ্যায়টে এবং ভিক্টর হুগোর (ফরাসিরা বলে, উগু। ভুলক্রমে এই বইতে ভিক্টর হুগোর দেশ জার্মানি ছাপা হয়ে গেছে ফ্রান্সের জায়গায়) চেয়ে রবীন্দ্রবনাথকে শ্রেষ্ঠ বলতে পারেন; সেই সময় যখন ইন্টারনেটের যুগ ছিল না; বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিশ্ব সাহিত্যের কত আগ্রহী পাঠক তিনি ছিলেন এবং কতটুকু তুলনামূলক বিচারের ক্ষমতা তাঁর ছিল। আরেকজন পণ্ডিতের রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক চর্চার কথা এই গ্রন্থখানির মাধ্যমে জানতে পেরেছি। বসন্তকুমার রায় বিনয়কুমার সরকারের সমসাময়িক না হলেও তাঁদের রবীন্দ্রনাথে অবগাহনের আগ্রহ এবং বিতরণের পথ প্রায় এক রকমেরই।
আমেরিকার শিকাগো থেকে প্রকাশিত কবিতা পত্রিকা ‘পোয়েট্রি’তে রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রকাশ হয়েছে একশ বছর আগে। ১৯১২ সালে কবি এজরা পাউন্ডের পাঠানো রবীন্দ্রনাথের ছয়টি কবিতা ছাপা হয়। ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকার সাথে বাঙালি কবিদের যোগাযোগ এখনো আছে। রবীন্দ্রনাথই হয়তো প্রথম বাঙালি কবি যিনি শিকাগো থেকে প্রকাশিত ‘পোয়েট্রিতে’ কবিতা ছাপিয়েছিলেন। এই তথ্যটি হয়তো এক সময় জানা যাবে এবং তা জরুরী।

সুব্রত কুমার দাস পণ্ডিত-গবেষক। তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ: কম-জানা অজানা’ গ্রন্থখানি পাঠ করে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেক অজানা তথ্য যেমন জেনেছি, তেমনি আন্তর্জাতিক পরিসরে মহাজ্ঞানী দুজন বাঙ্গালির (বিনয়কুমার সরকার ও বসন্তকুমার রায়) সন্ধান পেয়েছি। তাঁদেরকে জানার আগ্রহ জেগেছে। রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসেন এরকম যে কেউ গ্রন্থখানি পাঠ করলে উপকৃত হবেন। আমি সমালোচক নই, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে একটি গবেষণাগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করার স্পর্ধা আমার নেই।
অনেক পরিশ্রম করে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য আমাদেরকে গ্রন্থবদ্ধ করে জানিয়েছেন বলে গ্রন্থকার সুব্রত কুমার দাস-এর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানানোই এই লেখাটির উদ্দেশ্য।

রবীন্দ্রনাথ : কম জানা অজানা
সুব্রত কুমার দাস
প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০১১
প্রকাশক: গদ্যপদ্য, ঢাকা
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ করিগর