উৎস থেকে পরবাস: সুখপাঠ্য এক আত্মকথন
লেখক-গবেষক সুব্রত কুমার দাসের ‘উৎস থেকে পরবাস’ একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। তবে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ সাধারণত টানা গদ্যে যেভাবে লেখা হয় বইটি ঠিক সেরকম নয়। সুব্রত কুমার দাসের জীবনগাথার অভিনব উপস্থাপন বইটিকে সুখপাঠ্য করে তুলেছে। আরেক লেখক দেবাঞ্জনা মুখার্জি ভৌমিকের সাথে সুব্রত কুমার দাসের আলাপনের মাধ্যমে উঠে এসেছে তাঁর জীবনের গল্পগুলো। আলাপন শুরু হয়েছে ক্যানাডায় তাঁর অভিবাসী হওয়ার পেছনের কারণ কী ছিলো তা দিয়ে। তারপর এই আলাপনে প্রবেশ করেছে সুব্রত কুমার দাসের জীবন-সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়।
বাংলাদেশে থাকাকালীন লেখকের শিক্ষাজীবন, পেশাগত জীবন, তাঁর গ্রন্থপ্রীতি, ধীরে ধীরে তাঁর সাহিত্যিক হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত, ক্যানাডায় এসে প্রাথমিক স্ট্রাগল কাটিয়ে এখানকার মূলস্রোতের সাহিত্যের আঙ্গিনায় তাঁর প্রবেশ, রাইটার্স ইউনিয়ন অফ ক্যানাডা, টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অফ অথর্স-এর সাথে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো উঠে এসেছে আলাপনের প্রাথমিক পর্যায়ে। এরই মধ্যে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো এসেছে লেখকের ছেলেবেলার গল্প, এসেছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা, উদ্বাস্তু হয়ে কোলকাতায় চলে যাবার কথা, সেখানে গিয়ে তাঁর স্কুলজীবন শুরুর কথাও বলা হয়েছে সবিস্তারে। স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে কিশোর সুব্রত কুমার দাস কেমন ক’রে ‘বাঁশরী’ নামের একটি লাইব্রেরি শুরু করলেন সেই মজার কাহিনিও বলা হয়েছে আলাপনের প্রথম দিকে।
আলাপনের এক পর্যায়ে কন্যা ব্রতীকে লেখক কীভাবে কম্পিউটার শেখা, ইংরেজি শেখা, বই পড়া ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহী করে তুললেন সেকথাও বলেছেন বিস্তারিতভাবে। অ্যাকাডেমিক শিক্ষার বাইরে সন্তানকে অন্যান্য শিক্ষায় শিক্ষিত করার দায়িত্বটি যে মূলত পিতামাতা বা অভিভাবকের উপরেই বর্তায় এই বার্তাটি এই অংশে উপস্থাপিত হয়েছে এমন সরল কথনে যে পড়ে মনে হয় না লেখক পিতামাতা বা অভিভাবকদের কোনো উপদেশবাণী প্রদান করছেন। সমকালেই লেখক রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি শেখানোর পদ্ধতির সন্ধান পান এবং কন্যাকে সেই পদ্ধতিতে ইংরেজি শেখানোর কাজটি করেন। পরবর্তীকালে লিখেন ‘রবীন্দ্রনাথ: ইংরেজি শেখানো’ গ্রন্থটি। এই বইটি তিনি উৎসর্গ করেন কন্যা ব্রতীকে।
প্রবাস জীবনে কিছুটা থিতু হওয়ার পর টরন্টো থেকেই লেখকের একটি বই প্রকাশ পায় ২০১৬ সালে। শ্রীচৈতন্যদেবের উপর এই বইটি লেখার পূর্বাপর বৃত্তান্তও আমরা জানতে পারি আলাপন থেকে। সুব্রত কুমার দাস কানাডীয় সাহিত্য বিষয়ে যে বইটি লিখেন ‘কানাডীয় সাহিত্য: বিচ্ছিন্ন ভাবনা’ নামে সে বইটি লেখার জন্য তাঁর দীর্ঘ প্রস্তুতি, গবেষণা ইত্যাদি বিষয়েও আমরা জানতে পারি আলাপনের এক পর্যায়ে।
সুব্রত এই বইয়ে কয়েকজনের কথা বলেছেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে। পিতা বৈদ্যনাথ দাস সুব্রতর বৃত্তির টাকা দিয়ে ঢাকা থেকে বই কিনে আনতেন বলেছেন সে কথা। পিসেমশাই মৃণাল কান্তি ভৌমিক, সাহিত্যিক রুবী চৌধুরী এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আলী আনোয়ার স্যার তাঁর পাঠ-পরিধিকে প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে কীভাবে অবদান রেখেছেন সবিস্তারে বলেছেন সেকথা। গ্রন্থপ্রেমী ও লেখক সাঈদ যাদীদ, ভূতত্ত্ববিদ প্রশান্ত সরকার, লেখক মোল্লা বাহাউদ্দিন, মুক্তচিন্তার লেখক ও গণিতবিদ ড. মীজান রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক ড. জহিরুল ইসলাম, পন্ডিতজন নীলাদ্রি চাকী, স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী ও লেখক রঙ্গলাল দেব চৌধুরী, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত মাহফুজুল বারী প্রমুখকে উৎসর্গ করা হয়েছে বইটি। লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. দিলীপ চক্রবর্তী, কবি দেলওয়ার এলাহী প্রমুখের সাথে তাঁর সখ্যের কথাও তিনি বলেছেন অত্যন্ত শ্রদ্ধা ভরে। প্রবাস জীবনে এই গুণী ও প্রাজ্ঞজনদের সাথে কীভাবে তাঁর সখ্য গড়ে উঠে, তাঁদের সান্নিধ্য কীভাবে তাঁকে প্রাণিত করে আলাদা আলাদা অনুচ্ছেদে সবিস্তারে বলেছেন সেসব কথা।
‘উৎস থেকে পরবাস’ গ্রন্থে সুব্রত আরো বলেছেন ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে তাঁর ভাবনার কথা। বলেছেন ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা। এ বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি মনে করি প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ধর্ম পালনের যেমন স্বাধীনতা রয়েছে, তেমনি কেউ যদি মনে করেন তিনি নাস্তিক্যবাদী হবেন, ঈশ্বরে বিশ্বাস করবেন না — তার সে স্বাধীনতাও রয়েছে। আমি একই সাথে মনে করি পৃথিবীতে যে যেই মতের অনুসারী হোন না কেন, আমরা যদি পরস্পরকে, অন্য ধর্মের মানুষকে সম্মান দেখাতে না পারি তাহলে চূড়ান্তভাবে এই পৃথিবী আমরা বাসের উপযুক্ত করে রাখতে পারব না।”
ধর্মীয় সম্প্রীতি বিষয়ে বলতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথাও তিনি বলেন বিস্তারিতভাবে। মুসলমান পরিবারের কয়েক শো মানুষ কেমন ক’রে জীবন বাজি রেখে রাজাকারদের আক্রমণ থেকে তাঁর পরিবার এবং আরেকটি হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন, বলেছেন সেই কাহিনি। তিনি এই ঘটনাকে ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য এক উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করেন।
সুব্রত বাংলাদেশের উপন্যাস নিয়ে ওয়েবসাইট নির্মাণের কথাও বলেছেন এই গ্রন্থে। তাঁর এই স্বপ্নটি কীভাবে বাস্তবায়িত হোলো বলেছেন সে কথা। এমন কি জাদু বাস্তবতা ও চলচ্চিত্র বিষয়ে তাঁর নিজস্ব ভাবনার কথাও তিনি বলেছেন। প্রকৃতি ও মাতৃভূমির জন্য তাঁর ভালোবাসার কথাও তিনি বলেছেন বিস্তারিতভাবে।
সুখপাঠ্য এই বইটির মনোরম প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর এবং বইটি প্রকাশ করেছেন মূর্ধন্য প্রকাশনীর সঞ্জয় মজুমদার।