উৎস থেকে পরবাস: কর্মময় এক জীবনের বয়ান

সামিনা চৌধুরী

“উৎস থেকে পরবাস” লেখক সুব্রত কুমার দাসের আত্মজৈবনিক কথোপকথন গ্রন্থ।  সুব্রত কুমারের সাথে কথোপকথনটি করেছেন দেবাঞ্জনা মুখার্জি ভৌমিক। আর সে কারণে বইয়ের প্রচ্ছদে দেবাঞ্জনার নামের আগে  “আলাপনে” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেবাঞ্জনার বিভিন্ন প্রশ্নের  উত্তর দিয়েছেন লেখক সুব্রত কুমার দাস। লক্ষণীয় যে,  দেবাঞ্জনার প্রশ্নগুলি কালানুক্রমিকভাবে সাজানো হয়েছে। ফলে সুব্রত কুমারের দেয়া উত্তরগুলি একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থে রূপ নিয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার মূর্ধন্য প্রকাশনী।  ইতোমধ্যে বইটি এ বছরের ঢাকা, কোলকাতা ও আগরতলা বইমেলায় উপস্থাপিত হয়েছে।

আত্মজীবনী হচ্ছে লেখকের নিজের বয়ানে জীবনচরিত বা আত্মকথা।  মানুষ তাঁর জীবনের পথে একা হেঁটে যায়। তাঁর জীবনের পারিপার্শ্বিকতা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, বোঝার ক্ষমতা, শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা তাঁকে একজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।  তৈরি করে তাঁর জীবনবোধ ও দর্শন। নিয়ন্ত্রণ করে তাঁর কর্মকাণ্ড। পাশাপাশি এটিও জানা যায় সেই মানুষ নিজেকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন। তাই কারও জীবনের গল্প পাঠককে সমৃদ্ধ করে; দিক নির্দেশনা দেয়। আর সে কারণে আত্মজীবনী বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও একটি বিশেষ স্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

“উৎস থেকে পরবাস” বইটির ভূমিকায়, দেবাঞ্জনা খুব যৌক্তিক প্রত্যাশায় বলেছেন, “সুব্রত’র এগিয়ে চলার পথে গোলাপের পাপড়ি বিছানো ছিল না – এসেছে হাজার প্রকার প্রতিকুলতা। সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে যেতে তাঁর সেই কন্টকময় পথেও কীভাবে সফল হয়েছেন জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তা পাঠ করে পাঠকও উদ্বুদ্ধ হবেন।” বইটির ভুমিকায় দেবাঞ্জনা আরও বলেছেন “যখন বিশাল নদীর মত বয়ে গেছে তাঁর জীবন, তখন নদীর পাশে একেকটা গল্পের নুড়ি কুড়োতে কুড়োতে এগিয়ে চলে লিপিবদ্ধ করেছি তাঁর অতীতের স্মৃতি, বর্তমানের সাফল্য আর ভবিষ্যতের স্বপ্নকে। বইটির প্রতিটি পর্বে পাঠক তাঁর জীবনের নানা মোড়ের হদিস পেতে পেতে আবিষ্কার করবেন এক নিবিড় গভীর দার্শনিক মানবিক সুব্রতকে।” 

বইটি পড়লে বোঝা যায় দেবাঞ্জনার মন্তব্যের যথার্থতা। ২৪০ পৃষ্ঠার এই বইটিতে চিত্রায়িত হয়েছে সুব্রত কুমার দাসের ছেলেবেলার গল্প, বর্ণিত হয়েছে কীভাবে  এবং কাদের অনুপ্রেরণায় তিনি সাহিত্য ও গবেষণার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এবং ধীরে ধীরে কীভাবে একজন লেখক হয়ে উঠেছেন। সুব্রত কুমার দাসের এ পর্যন্ত ২৯টি সাহিত্য,  গবেষণা,  সম্পাদনা ও অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশনার পেছনের গল্পগুলোও উঠে এসেছে। এসেছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম কোড়কদি নিয়ে সুব্রত কুমারের নিবিড় পর্যবেক্ষণ, গবেষণা, প্রকাশনা। লুপ্ত ঐতিহ্যকে জনসমক্ষে আনার ব্যাপারে সুব্রতর যে উদ্যোগ, সেটি অনন্য,   অসামান্য,  অনবদ্য এবং অনুসরণীয় একটি উদাহরণ। বইটিতে এই অপুর্ব গল্পটিও  স্থান পেয়েছে। মহাভারত ও শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে সুব্রতর গবেষণা ও প্রকাশনা, বেদ, গীতা, ধর্ম বিষয়ে লেখকের বোধ ও দর্শন, যাদুবাস্তবতা বিষয়ে লেখকের  ভাবনা এবং আরও অনেক বিষয় প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বলা হয়েছে, যা পাঠকের আগ্রহকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। 

এছাড়াও দুই দশক ধরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনাকালে সুব্রত কুমারের অনেক সফলতা আর উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে এই গ্রন্থে। উঠে এসেছে ইউনেস্কোর সাথে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা। আলোচিত হয়েছে ঠিক কুড়ি বছর আগে বাংলা সাহিত্যের প্রথম ওয়েবসাইট www.bdnovels.org  নির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের গল্প। 

একই সাথে বইটিতে কানাডীয় প্রবাস জীবনের লেখকের দশ বছরের পথচলার গল্পও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে কেন সুব্রত কুমার প্রবাসী হলেন। বলা হয়েছে নতুন দেশে সুব্রত’র সংগ্রাম আর অর্জনের গল্প। কানাডায় আসার পর কীভাবে একার চেষ্টায় নিজ অনুপ্রেরণায়  সুব্রত কানাডীয় সাহিত্যে নিমগ্ন হয়েছেন, এবং কানাডীয় সাহিত্য নিয়ে বই লিখেছেন। কানাডার সাহিত্য নিয়ে প্রথম সেই বাংলা বই নিয়ে আলোচনা প্রকাশিত হয়েছিল উত্তর আমেরিকা থেকে প্রকাশিত প্রায় সকল বাংলা সংবাদপত্রেই।

নতুনদেশে বাংলা সাহিত্য চর্চার প্রসারে বিএলআরসি প্রতিষ্ঠায় লেখকের উদ্যোগ এবং Toronto International Festival for Authors (TIFA)-য়  অংশগ্রহণের বৃত্তান্ত  উঠে এসেছে কথোপকথনের প্রাসঙ্গিকতায়। প্রতিবছর কানাডায় Top 25 Immigrants এর যে লিস্ট করা হয়, সুব্রত’র নাম সেই লিস্টের শর্টলিস্টে অন্তর্ভুক্ত হবার  মতো অসামান্য অর্জনের প্রেক্ষাপটটিও পাঠক জানতে পারবেন। গত দশ বছরে লেখক কানাডায় এবং কানাডার বাইরে কয়েকবার ভ্রমণ করেছেন। এইসব ভ্রমণের বিস্তারিতও বইটিতে বলা হয়েছে।

বইটি টরন্টোর যে দশজন প্রয়াত প্রজ্ঞাবানকে উৎসর্গ করা হয়েছে, তাঁদের সাথে লেখকের বিভিন্ন স্মৃতির পড়তে পাঠক নষ্টালজিক হয়ে উঠবেন। পাশাপাশি দেখা যায়  খুব আন্তরিকতার সাথে সুব্রত কুমার দাসের  কিছু বন্ধুরাও হয়ে উঠেছেন বইটির চরিত্র। নতুন বন্ধুদের  ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা আর দিকনির্দেশনার জন্য সুব্রত তাঁর বন্ধুদের বিনম্র ধন্যবাদও জানিয়েছেন।  

বইটির গল্পগুলো সুব্রত কুমারের জীবনের ধারাবাহিকতা মেনে এগিয়ে গেছে। কাজেই পড়ার সময় পাঠক  সুব্রত কুমারের প্রায় ৬০ বছরের জীবনের ধাপগুলো খুব স্পষ্ট করা আলাদা করতে পারবেন। সে কারণে পাঠক সুব্রতর জীবনের একটি গল্পের পর অন্য গল্পটি জানতে চাইবেন। খুব আগ্রহে বলে উঠবেন “তারপর কী হলো?” সে কারণে গল্প বলায় লেখকের মুন্সিয়ানাকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। আর তাই বইটি সুলিখিত হয়েছে বলেও দাবী করা যাবে। 

বইটি পড়ার সময় পাঠক মনের চোখে টেলিভিশনের পর্দায় দেবাঞ্জনা আর সুব্রত কুমারের সাক্ষাতকারটি দেখতে পাবেন। পাঠক মনের চোখে ঘুরে আসতে পারবেন লেখকের ছেলেবেলার দিনগুলোতে।  দেখতে পারবেন আরেকটি পথের পাঁচালীর আরেকজন অপু  খুব যত্ন করে যে টিনের বাক্সে গুছিয়ে রাখছে তার প্রিয় বইগুলি। পাঠক ঘুরে আসতে পারবেন সেই রক্তঝরা একাত্তরে। অনুভব করতে পারবেন সেই সময়ের সেই আতংক আর ত্রাস। কোন বর্ণনা যখন অনন্য মাত্রায় পৌঁছায় তখনই এই দৃশ্যময়তা পাঠক অনুভব করেন। সেভাবে লেখক সফল হয়েছেন কারণ বইটি প্রাঞ্জল ও প্রাণবন্ত। 

বইটিতে গতানুগতিক সূচীপত্র না দিয়ে ‘আলাপনের প্রধান বিষয়গুলো’ তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে যেটি অর্থবহ। কারণ আত্মজীবনী হচ্ছে জীবনের স্মৃতি,  জীবনের গল্প।  এটি বলতে বলতে আলাপচারিতা এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে চলে গিয়েছে সহজেই। আরেকটি সুবিধা হলো আলাপনের বিষয়গুলোর তালিকা দেখে দেখে পাঠক বইটির যে কোন অংশ পড়তে পারবেন সুবিধেমতো। 

বইটিতে বালক সুব্রত কুমারের বই সংগ্রহ করে টিনের বাক্সের লাইব্রেরি বানানোর গল্প থেকে শুরু হয়ে লেখকের প্রবাস জীবনের দশ বছরের যাত্রা বর্ণিত হয়েছে। এ কারণে বইটির নাম “উৎস থেকে পরবাস” খুব সেল্ফ এক্সপ্লানেটরি।

বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন বাংলাদেশের নন্দিত শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর। প্রচ্ছদে সবুজ খন্ডত এর উপর লাল বৃত্ত দিয়ে বাংলাদেশের পতাকার প্রতীকি ব্যবহার এবং সাদা দন্ত্য স এর  উপর লাল মেপল পাতা দিয়ে কানাডার পতাকার প্রতীকি ব্যবহার প্রচ্ছদটিকে অর্থবহ করেছে। প্রচ্ছদে তাকালেই বাংলাদেশ আর কানাডার গল্প শোনার জন্য মন যেন প্রস্তুত হয়ে উঠে। 

বইটিতে আমরা লেখক সুব্রত কুমার বা সমাজসেবী সুব্রত কুমারকে যতটা জেনেছি, ব্যক্তি সুব্রত কুমারকে ততটা জানতে পারিনি। হয়তোবা স্বভাবসুলভ লাজুকতায় ব্যক্তি সুব্রত কুমার প্রসঙ্গটি ইচ্ছে করেই বাদ দেয়া হয়েছে বলে আমার ধারণা। আমরা আশা করবো লেখক পরবর্তী আত্মজীবনীতে এটি অন্তর্ভুক্ত করবেন। কারণ পাঠকের চোখে লেখকের ব্যক্তিজীবনও অনেক দামী গল্প। আর এ প্রসঙ্গে লেখক নিজেই বলেছেন, “মানুষ কখনোই তাঁর মনের পুরোটা বলতে পারে না। পুরোটা বলার ভাষা কোন মানুষ জানে না। সে ক্ষমতা কোন মানুষের নেই। এই  না-পারাটাই মানুষ জীবন।” 

মহান সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি মানুষকে আলাদা করে সৃষ্টি করেছেন।  প্রতিটি মানুষের পথ আলাদা,  সংগ্রাম আলাদা, প্রতিটি মানুষের গল্প আলাদা। একজন মানুষকে জানতে হলে,  সেই মানুষটা কোন পথে হেঁটে আজ এতদূর এসেছেন সেটা জানা দরকার।  আর সে পথে যিনি হেঁটেছেন, সেই পথের গল্প তিনিই সবচেয়ে ভাল বলতে পারেন। লেখক সুব্রত কুমার দাস সেটা পেরেছেন। 

সুব্রত কুমার দাসের সামনে এখনও অনেক পথ। আমরা আশা করি তিনি আরও বই লিখবেন,  আরও অনেক সামাজিক ও সাহিত্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। আর তাই ভবিষ্যতে তাঁর আরেকটি আত্মজীবনীর জন্য পাঠকও অপেক্ষায় রইবেন।

……………

সামিনা চৌধুরী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন। সরকারি কলেজে অধ্যাপনাকালে বাংলাদেশ ইউনেস্কো কমিশনেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে যুক্ত হন ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশে-বিদেশে সামিনার মোট নয়টি পিয়ার রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে কানাডায় অভিবাসী সামিনা পাঁচ বছর ধরে টিডি ব্যাংকে কাস্টমার কেয়ার বিভাগে কাজ করছেন।