উপন্যাসের শিল্পরূপ
আউয়াল মুছুল্লী
সাহিত্য সমালোচক সুব্রত কুমার দাসের বাংলাদেশের কয়েকজন ঔপন্যাসিক গ্রন্থটি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। বাংলাদেশের উপন্যাস নিয়ে সামগ্রিক পর্যালোচনার পরিসর একেবারে কম না হলেও ঔপন্যাসিকদের সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনাগ্রন্থের তালিকা খুব একটা দীর্ঘ নয়।
বাংলাদেশের কয়েকজন ঔপন্যাসিক বইটি দশজন ঔপন্যাসিকের মৌল প্রবণতা, জীবনঘনিষ্ঠ ও সমাজনিরীক্ষাধর্মী শিল্পদর্শন, চরিত্র নির্মাণ ও মনো-বিশ্লেষণ, নিসর্গপ্রকৃতি ও মানবজীবন- সর্বোপরি সমকালীন কথাসাহিত্যে তাঁদের মান ও অবস্থান, কাহিনী বিন্যাসের বয়নদক্ষতা ও বর্ণিত বিষয়ের অন্তরালে আভাসিত বিষয়গুলো সুব্রত কুমার দাস তুলে এনেছেন। ঔপন্যাসিক অন্তর্ভুক্তি প্রশ্নে গ্রন্থকারের নিবেদন:গ্রন্থটি কোনক্রমেই বাংলাদেশের প্রধান বা নির্বাচিত ঔপন্যাসিকদের নিয়ে রচিত নয়। পাঠ পরিক্রমায় যে সকল লেখক সাম্প্রতিক অতীতে পুরোপুরি বা প্রয়োজনীয় ব্যাপকতায় আমার সামনে উপস্থিত হয়েছেন তাঁরাই এতে অন্তর্ভুক্ত।
আলোচিত কথাসাহিত্যিকদের রচনাকর্মের চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের প্রয়োজনে তিনি বেছে নিয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, আবু ইসহাক, শহীদুল্লা কায়সার, আল মাহমুদ, মাহমুদুল হক, হরিপদ দত্ত, হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, ইমদাদুল হক মিলন ও নাসরীন জাহানকে।
‘সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্: তাঁর উপন্যাসের বয়ন ও ইঙ্গিত সূত্রের অনুসন্ধান’ নামের প্রবন্ধে অনেকের মত সুব্রত কুমার দাসও ওয়ালীউল্লাহ্কে বাংলা উপন্যাসের অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানে আগ্রহী; তার কারণ ওয়ালীউল্লাহ্র রচনার কৌশল এবং ইঙ্গিতময় ও ব্যঞ্জনাধর্মী উপস্থাপন। প্রাবন্ধিকের বিশ্বাস ‘অভিনব এবং সুপ্রযুক্ত সে-পদ্ধতির কারণেই ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস পুনঃপাঠের পরও পাঠ দাবি করে থাকে (পৃ ১২)।’ আলোচিত প্রবন্ধটিতে দেখানো হয়েছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র প্রতিটি বাক্য এবং শব্দ প্রযুক্ত হয় হিসেবনিকেশের পর যা পাঠককে নতুনতর বোধে নিয়ে যায় পুনঃপুন পাঠে। প্রসঙ্গত তিনি কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসের মুহম্মদ মুস্তফা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলে অপ্রত্যাশিতভাবে কলিজাটির কথা তার মনে পড়ে, যেখানে খোদার কথা বলা হয়েছে, সে প্রসঙ্গ এনেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দুঃসাহসী ও ইঙ্গিতময় চিত্রের ব্যবহার সুব্রত কুমার দাস গ্রন্থশুরুর এ প্রবন্ধে তুলে আনতে প্রয়াসী হয়েছেন।
‘আবু ইসহাক: দ্রোহী গ্রামজীবনের রূপকার’ এই বইয়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধ। প্রবন্ধের শুরু সমকালীন উপন্যাস-ভুবন ও প্রতিষ্ঠিত ঔপন্যাসিকদের প্রতিতুল বিচারে আবু ইসহাকের সাযুজ্য বিশ্লেষণ এবং জনপ্রিয়তার নিরিখে তাঁর সৃজনকর্মের অবস্থান আলোচনা প্রসঙ্গে। আবু ইসহাকের সূর্যদীঘল বাড়ি উপন্যাসে দরিদ্র অথচ মহৎ নারী চরিত্রের যে দ্রোহ তাকেই প্রাবন্ধিক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আবু ইসহাককে দ্রোহী গ্রামজীবনের রূপকার হিসেবে দেখানোর চেষ্টা বহুলাংশে রূপলাভ করেছে জয়গুণ চরিত্রের ভেতর দিয়ে। জয়গুণ চরিত্র পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে সুব্রত কুমার দাস জয়গুণের দ্রোহ এমন কি ধর্মের নামে শাসনের বিরুদ্ধেও তার দ্রোহের সাহসী রূপায়ণকেই দেখাতে আগ্রহী:
… গ্রামীণ এই রমণী ছেলেমেয়ের মুখের দিকে চেয়ে ধর্মের অনুশাসন ভুলে যায় সহজেই, কেননা সে তো ঘরপোড়া গরু।
সূর্যদীঘল বাড়ি থেকে পদ্মার পলিদ্বীপ উপন্যাসকে অনেক বেশি সংহত রূপে দেখানো হয়েছে এ প্রবন্ধে:
চরাঞ্চলের একটি পরিপূর্ণ জীবনধারার সাথে এ উপন্যাস সমসাময়িক যেসকল প্রসঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে তার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম সমাজ পর্যন্ত কেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (পৃ ২৩)
‘শহীদুল্লা কায়সার: অনালোচিত উপন্যাসের আলোকে’ শিল্পসমৃদ্ধ একটি প্রবন্ধ। পাঠকনন্দিত উপন্যাস সারেং বউ ও সংশপ্তক-এর চেয়ে গবেষক সুব্রত কুমার দাস কবে পোহাবে বিভাবরী- যা- লেখার সূত্রপাত ১৯৭১-এর ২রা এপ্রিল, সে-উপন্যাসকেই অধিকতর মূল্যবান বিবেচনা করেছেন। প্রবন্ধপাঠে পাঠক মাত্রই উৎসাহী হবেন যুদ্ধকালীন বৈরি অবস্থার মধ্যে কীভাবে শহীদুল্লা কায়সার তাঁর এ-উপন্যাস রচনায় অগ্ররসমান ছিলেন, তা ভাবতে। সংঘশক্তির ভাষাচিত্র নির্মাণে ঔপন্যাসিকের দক্ষতার বিবরণ প্রাবন্ধিকের বিশ্লেষণ-প্রবণতাকে আরও বেশি গ্রহণীয় করে তোলে:
ঔপন্যাসিক একটি পরিবারের কিছু মানুষকে নিয়ে যে কাহিনী শুরু করেছিলেন সময়ের দাবিতে সে মানুষগুলো মিশে গেছে পুরো দেশের জনগোষ্ঠীর সাথে। (পৃ ৩৩)
এ প্রবন্ধের বস্তুনিষ্ঠ অন্তর্বিশ্লেষণ ও তথ্যবহুল আলোচনায় অন্যান্য উপন্যাসের তুলনায় অসমাপ্ত উপন্যাস কবে পোহাবে বিভাবরী শহীদুল্লা কায়সারের মেধা প্রকাশের প্রতিনিধিত্বকারী সৃজনকর্ম বলে বিবেচ্য হয়ে ওঠে।
বইয়ের অপর প্রবন্ধ ‘আল মাহমুদ: তাঁর উপন্যাসের জগৎ’। সূচনাতেই চিত্রকল্প নির্মাণে কথাশিল্পী হিসেবে কবি আল মাহমুদ স্বীকৃতির এক নান্দনিক ভাষাচিত্র নির্মাণ করেছেন লেখক। প্রাবন্ধিক তাঁর দ্বিধাহীন, অকপট ও পরিপুষ্ট উচ্চারণে উপন্যাসের অসঙ্গতি যেমন মেলে ধরেছেন, তেমনি তুলে এনেছেন অভিনব বিষয়-নির্বাচনে শিল্পীর দক্ষতা এবং পরিকল্পনাকে।
‘মাহমুদুল হক: বিষয় ও শৈলী বিবেচনা’ লেখকের সৃজন-প্রক্রিয়ার প্রতিনিধিত্বশীল প্রবন্ধ। মাহমুদুল হকের সাতটি উপন্যাসের আলোচনায় গবেষক তাঁর মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন।
মাহমুদুল হক নিরীক্ষায় সফল, নিজস্ব নির্মাণে দ্রোহী, নগর চেতনায় গ্রামজ, অনুভবে পুঙ্খানুপুঙ্খু। আধুনিক মনস্কতায় পাঠক হৃদয়ে ছাপ ফেলে তাঁর প্রতিটি প্রচেষ্টা। (পৃ ৪৮)
বিষয় ও শৈলী বিবেচনায় মাহমুদুল হকের একটি উপন্যাস যে অন্য-আরেকটি উপন্যাসের চর্বিতচর্বণ নয়, প্রবন্ধ পাঠে তার সত্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের কয়েকজন ঔপন্যাসিক গ্রন্থের অন্যতম নির্মাণ ‘হরিপদ দত্ত: তাঁর উপন্যাসের প্রথম পর্ব’। আলোচ্য প্রবন্ধের পাতায় একের পর এক নজর দিলে অনুমান করা যাবে কতটা দক্ষতা ও অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুব্রত কুমার দাস হরিপদ দত্তকে মেলে ধরেছেন পাঠকের সম্মুখে। গ্রামীণ মানুষের মুখে মুখে যে প্রবাদ প্রবচন শালীনতা অশালীনতা পার্থক্য পাশে ঠেলে প্রকাশ পায় অন্ধকূপে জন্মোৎসব-এ, সেসব কতটা শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে পাঠকের মনে আনন্দের সৃষ্টি করে প্রবন্ধপাঠে তা সহজেই অনুমেয়। গ্রামীণ ছড়া, খনার বচন, রূপকথার নানা কাহিনীর সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাবেশ উপন্যাসের মূলসুরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে কতটা শিল্পসার্থকতায় মাত্রা দান করেছে, তা প্রাবন্ধিকের বর্ণনায় স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। হরিপদ দত্তের অজগরকে তিনি বঙ্গীয় অঞ্চলের মহাকাব্য আখ্যা দিয়েছেন, যেখানে একই সঙ্গে রাজনীতি ও সামাজিক অন্তর্বলয় অন্তর্লীন হয়ে মিশে আছে। এ প্রবন্ধের অত্যতম বিশেষ দিক হল-হরিপদ দত্তের উপন্যাসের ব্যবহৃত চিত্রকল্প ও তুলনা প্রসঙ্গ। এই প্রবন্ধ পাঠে পাঠকের মনে হবে প্রাবন্ধিক যেন পল্লী সাহিত্যের এক বিশাল রত্নভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছেন।
‘হুমায়ূন আহমেদ: কয়েকটি উপন্যাসের আলোকে’ একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ। যুক্তিনির্ভর, বুদ্ধিবৃত্তিক ও তথ্যবহুল এ প্রবন্ধের আলোচনায় হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার কারণ অনুসন্ধান এবং তাঁর উপন্যাসে চরিত্র, বক্তব্য ও ভাবনায় এমন কি পাত্র-পাত্রীর সংলাপে পৌনঃপুনিকতার বিষয়টি প্রাবন্ধিক উপস্থাপন করেছেন।
তাঁর প্রচলনের বাইরে গিয়ে, বিষয় ও শৈলীর অভিনবত্বের অনুসন্ধানের মাধ্যমে হুমায়ূন কি একটি মহৎ উপন্যাসও পাঠককে উপহার দিতে পারেন না যা হবে কথা সাহিত্যিক হুমায়ূনের প্রথম পরিচয়? (পৃ ৯৪)
‘মুহম্মদ নূরুল হুদা: কক্সবাজারের লোকজীবন আর প্রকৃতির কথাকার’ প্রবন্ধে জন্মজাতি ও মৈনপাহাড় উপন্যাস সম্পর্কিত আলোচনায় দেখিয়েছেন কথাসাহিত্যিক নূরুল হুদা তাঁর উপলব্ধিজাত অভিজ্ঞতায় কতবেশি সাবলীল ও আত্মপ্রত্যয়ী। বর্ণিত লোকজীবন ও নিসর্গ প্রকৃতির মধ্যে অবিচ্ছেদ্য টানাটানির সম্পর্কটি প্রাবন্ধিক নিবিড় মমতায় তুলে এনেছেন, সেখানে একটি বিশিষ্ট অঞ্চলের মানবজীবনের সম্ভাব্য সকল দিকই ফুটে উঠেছে।
আলোচ্য গ্রন্থের শেষ দুটি প্রবন্ধের একটি ‘ইমদাদুল হক মিলন: জনপ্রিয় উপন্যাসিকের মেধাবী স্বাক্ষর’, অন্যটি ‘নাসরীন জাহান: স্বপ্নে বাস্তব এবং বাস্তবে যাদু’। মিলনকে সুব্রত দেখেছেন সম্পূর্ণ ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে। আগামী প্রত্যাশায় প্রাবন্ধিকের দ্বিধাহীন উচ্চারণ:
ইমদাদুল হক মিলন কোন মহৎ উপন্যাস লিখেছেন কিনা সে তর্কে না যেয়েও বলা যায় তিনি অনেকগুলো ভাল উপন্যাস লিখেছেন … তাঁর বিশাল রচনাসম্ভারে যাবজ্জীবন, ভূমিপুত্র এবং নূরজাহান-এর মত উপন্যাস যে আরও রয়েছে তেমনটিও অনুমান করা যেতে পারে। (পৃ ১১৮)
বাস্তব সত্য আর শিল্প সত্য নাসরীন জাহানের উপন্যাসে কেমন করে খেলা করে তা প্রাবন্ধিক মেলে ধরেছেন গ্রন্থের সর্বশেষ প্রবন্ধে। ‘নাসরীন জাহান: স্বপ্নে বাস্তব এবং বাস্তবে যাদু’ প্রবন্ধে এসব বিচারে নাসরীন জাহান হয়ে উঠেছেন এক মননশীল লেখক।
সব শেষে বলা চলে শিল্পগুণ বিচার এবং কতিপয় উপন্যাসের তুলনামূলক আলোচনায় লেখকের প্রতিটি প্রবন্ধ আপন আপন স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
বাংলাদেশের কয়েকজন ঔপন্যাসিক
সুব্রত কুমার দাস
সূচীপত্র, ঢাকা, ১২৫ টাকা