ইয়েটস নিয়ে প্রশংসনীয় বাংলা গ্রন্থ

ড. সুজিত দত্ত

বিশ শতকের বিশ্বসাহিত্য গগনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষ্ক উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস (১৮৬৫–১৯৩৯) একাধারে কবি, নাট্যকার, আইরিশ সিনেটর এবং উদ্যমী সংগঠক। ‘লাস্ট রোমান্টিক’ হিসাবে সাহিত্যাঙ্গনে আত্মপ্রবেশ করলেও ক্রমাগত কাব্যধারার বাঁক পরিবর্তন করে পরবর্তীতে বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতা এবং জীবন বোধ ও বৈশ্বিক বীক্ষার সংমিশ্রনে রচনা করেন অনুপম শৈলীসমৃদ্ধ আধুনিক কবিতা যার আবেদন সার্বজনীন ও কালজয়ী। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন ১৯২৩ সালে। নোবেল কমিটির বর্ণনা মতে ইয়েটসের কবিতা লালিত্যময় রচনাশৈলী সমৃদ্ধ এবং এক সামগ্রিক জাতিসত্তায় অনুপ্রাণিত  “… inspired poetry, which in a highly artistic form gives expression to the spirit of a whole nation.”

আইরিশ জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত আধুনিক ইংরেজি কবিতার দিকপাল ডব্লিউ বি ইয়েটসের ১৫০তম জন্মদিন সম্প্রতি সারা বিশ্বে সাড়ম্বরে উদযাপিত হলো। “গীতাঞ্জলি”র অনুপম কাব্যসম্ভার পশ্চিমা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার সেতুবন্ধ রচনা করে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার বিজয়ে  ইয়েটসের অসামান্য অবদান বাঙালি জাতি কখনও বিস্মৃত হতে পারে না। সার্ধ্বশততম জন্মজয়ন্তী উৎসবের বিশ্বব্যাপী আয়োজনের অংশ হিসাবে বরেণ্য এই কবির প্রতি একজন অনুরাগী এবং মননশীল বাঙালি পাঠক সুজিত কুসুম পালের শ্রদ্ধার্ঘ্য – “ইয়েটসের কবিতায় নারী ও নিকুঞ্জ” এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ – এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

ইয়েটসের কাব্য-অনুপ্রেরণার মূল উৎস দু’টি একটি নিজের প্রিয় মাতৃভূমি আয়ারল্যান্ডের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা; অন্যটি রমণীর প্রতি, বিশেষ করে সুন্দরী রমণীর প্রতি তাঁর অনিবার্য আকর্ষণ। মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসায় উদ্দীপ্ত ইয়েটস এমন এক বিশিষ্ট কাব্যধারা সৃষ্টি করেছেন যা ভাব, বোধ ও শৈলীতে নিতান্তই আইরিশ – “Purely Irish in tone and object matter.”

অনেকের মতে ইয়েটস সত্যিকার অর্থে একজন রমণীমোহন। সুন্দরী ললনারা তাঁর সান্নিধ্যে সম্মোহিত হতেন; একই ভাবে রমণী-সাহচর্যে তিনি সবচেয়ে বেশী অনুপ্রাণিত বোধ করতেন। রমণীরা ছিলেন তাঁর কাছে Muse বা কাব্যলক্ষ্মী – তাঁর বিখ্যাত প্রেমের কবিতাগুচ্ছ নিবিড় সম্পর্কের রমণীদের প্রতি তাঁর হৃদয়ের আবেগ ও ভালোবাসার বিমূর্ত উচ্চারণ। ইয়েটসের জীবনীকার Joseph Hassett -এর বিখ্যাত গ্রন্থ – “W. B. Yeats and the Muses”-এ যথার্থই লিখেছেন, “… These interesting women rallied around him, trying to keep him alive, trying to keep him inspired….”

“ইয়েটসের কবিতায় নারী ও নিকুঞ্জ” শিরোনাম থেকে বোঝা যায় গ্রন্থটি ইয়েটসের সামগ্রিক কাব্য-ভাণ্ডারের অনুপুঙ্ক্ষ বিশ্লেষণ নয়। নারী সংক্রান্ত ঘটনা প্রবাহ ইয়েটসের জীবন ও কবিতাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে তা একজন শিল্পীর রঙ তুলি দিয়ে রাঙিয়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন এক আকর্ষণীয় বর্ণনাত্মক ভঙ্গীতে। পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য গ্রন্থকার ইয়েটসের জীবনের বাস্তব ঘটনাবলী কল্পনার সুতোয় বয়ন করেছেন আপন মনের মাধুরী দিয়ে। পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে বইটি যেন কাহিনীর পর কাহিনি সম্বলিত সুবিন্যস্তভাবে সাজানো একটি জীবন্ত উপন্যাস যা এক চৌম্বকীয় আকর্ষণে পাঠকের মনকে ধরে রাখে।

ইয়েটসের জীবনে এসেছে একাধিক রমণী, নারীর টানে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন নিকুঞ্জ থেকে নিকুঞ্জে। নিজের Memories – এ তিনি লিখেছেন, “If I could get a woman I loved, it would be a comfort even for a little while to devote myself to another.” ইয়েটসের কবিতায় যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি পরিবর্তন এসেছে নারীর প্রতি তাঁর ভালোবাসায়। যে সব রমণী ইয়েটসের জীবনকে খুব বেশী প্রভাবিত করেছেন তাঁদের মধ্যে Maud Gonne, Iseult, Olivia Shakespear এবং স্ত্রী Georgie অন্যতম। বইটিতে ইয়েটস এর সাথে রমণীর নিবিড় সম্পর্কের মনস্তাত্বিক পর্যালোচনা কৌতুহলী পাঠকের মনোরঞ্জন করবে।

গ্রন্থকার বলেছেন সাধারণ পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য তিনি বইটি লিখেছেন। ইয়েটসের জীবন ও কবিতার কথা বলতে গিয়ে তিনি সমসাময়িক অন্যান্য লেখকদের সাহিত্যকর্মের আলোচনা করেছেন। আলোকপাত করেছেন Blake, Shelley, Keats, Eliot এবং Auden এর কবিতার উপর। ফলে বইটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র-ছাত্রীদেরও উপকারে আসবে। লেখক টেনে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ-ইয়েটস প্রসঙ্গ যাতে অনুসন্ধিৎসু পাঠক অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন। বইয়ের পরিশিষ্টে সংযোজিত প্রবন্ধ ও গ্রন্থাবলীর তালিকা একদিকে যেমন আগ্রহী পাঠককে অনুপ্রাণিত করবে, তেমনি ভবিষ্যৎ গবেষণা কর্মেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

সুজিতের ভাষা প্রাঞ্জল ও গতিশীল। বাক্য গঠনের অভিনবত্ব ও শব্দচয়নের বাহাদুরি পাঠকের মন কাড়ে। দৃষ্টান্ত হিসাবে বই এর প্রারম্ভিক লাইনটি এখানে উদ্ধৃত করছি যাতে সুন্দরী Maud Gonne-এর প্রণয় প্রত্যাশী কবি ইয়েটস এর মানসলোকের একটি বাস্তব চিত্র পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে এভাবে –

“অনাদিকালের কাব্যরসে নিমগ্ন বিহঙ্গের পাখায় চড়ে সারা অঙ্গে বসন্তের প্রান্তে ফোটা আপেল পুষ্পের লালিমা আর বর্ণালী চুলের আড়ালে স্বর্ণালী নয়ন জোড়া মহিমার সৌরভ ছড়াতে ছড়াতে স্বপ্নের ললনার পদার্পণ হলো অবশেষে ল-নের পৈতৃক নিকুঞ্জে।”

অভিনবত্ব চোখে পড়ে গ্রন্থকারের চিত্রকল্প ও প্রতীকের ব্যবহারে। জ্যামিতিক চিত্রকল্পের মাধ্যমে তিনি পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন কবি ইয়েটস ও তাঁর প্রণয়িনীদের অনুকুল, প্রতিকুল, সমান্তরাল ও বিপ্রতীপ মনোভাবসমূহ যা সংবেদনশীল পাঠকের হৃদয়কে নাড়া দেবে।

লেখকের প্রথম প্রয়াস হিসাবে বইটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। সাহিত্য সংগঠন বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি) বইটি প্রকাশ করে টরন্টোতে বাংলা প্রকাশনায় এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। আমি বইটির সাফল্য কামনা করি। পাঠকের প্রত্যাশা গ্রন্থকার আরও নতুন নতুন বই-এর ডালি নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থিত হবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস লেখক সুজিত কুসুম পাল পাঠকের প্রত্যাশা পূরণ করবেন।