ইয়েটসের নারী ও নিকুঞ্জ
ইংরেজি সাহিত্যের একনিষ্ঠ সাধক, গবেষক সুজিত কুসুম পাল পরিশুদ্ধ ও বিমুগ্ধ নেত্রে আর মননে অবলোকন করেছেন আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের জীবনী। ইয়েটসের জীবনী নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে লেখা বই ইয়েটসের কবিতায় নারী ও নিকুঞ্জ ২০১৬ সালে টরন্টোর বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি) থেকে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি সাহিত্যের শেষ রোমান্টিক কবির সব লেখার রোমান্টিকতার আধার হিসেবে তাঁর স্মৃতিতে চির পূজনীয় নশ্বর নারীকুলকেই খুঁজে পান পাঠক। আধ্যাত্মিক প্রেমিকা মড গন, মড-কন্যা ইসল্ট, প্রেমিকা অলিভিয়া শেক্সপিয়ার ও স্ত্রী জর্জিয়া ইয়েটসকে প্রভাবিত করে রেখেছিলেন তাঁর পুরোটা যৌবনজুড়েই। যৌবন পেরিয়ে ইয়টেস যখন মৃত্যুশয্যায়, তখনো তাঁর জীবনের অপ্রাপ্তির ঝুলিতে ছিল শুধু অসাধারণ সুন্দরী আইরিশ জাতীয়তাবাদী নেত্রী মড গনকে না পাওয়ার অতৃপ্তি।
রমণীমোহন বলে সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত ইয়েটস তাঁর সৃষ্টির অনুপ্রেরণা পেয়েছেন রমণীকুল থেকে, এটা সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু সে প্রেম কিংবা মোহ তাঁকে নিবিড়ভাবে আচ্ছন্ন করে রাখলেও নিষ্ক্রিয় করেনি কখনো। বরং তাঁর কাব্যলক্ষ্মী হয়ে তাঁরা সর্বদা সাহিত্য রচনায় তাঁকে নিত্য নতুন রসদ জুগিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানো অন্যান্য নারীর মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেত্রী, পরিচালক ও কাহিনিকার ফ্লোরেন্স ফার। ক্যানসারে তাঁর মৃত্যু কাঁদিয়েছিল কবিকে। ছিলেন লেডি গ্রেগরি, যিনি ইয়েটসের জীবনে কোচের ভূমিকায় ছিলেন। ব্যক্তিগত, পেশাগত সব সমস্যার সমাধান পেতেন তাঁর কাছে। আর ইয়েটসও তাঁকে মনে করতেন যেন নিজের জীবনের রোজনামচা লেখার খাতা।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইয়েটসকে ঘিরে থাকা নারীরা ছিলেন বেশ ব্যতিক্রমী আর সুধী সমাজে বেশ সম্মানিত। ইয়েটসের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কও ছিল ভিন্ন ধারার। তাতে প্রেম যতটা না ছিল শারীরিক, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল আধ্যাত্মিক। তাতে ছিল না কোনো পাপ; বরং ছিল সৃষ্টির উন্মাদনা, অনুপ্রেরণা, উৎসাহ এবং অনাবিল সুখের সংস্পর্শ। এ যেন আত্মার প্রেম, আধ্যাত্মিক সম্পর্ক যা ছুঁয়ে রেখেছিল ইয়েটসের কাব্যসাধনার প্রহরগুলোকে।
ইয়েটসের নারী ও নিকুঞ্জ বইয়ে পাঠকদের সঙ্গে লেখক প্রথমেই পরিচয় করিয়ে দেন ছয় ফুট উচ্চতার আইরিশ জাতীয়তাবাদী নেত্রী মড গনের সঙ্গে। শুধু আইরিশ জাতীয়তাবাদী নেত্রী বললে মড গনের পরিচয় অসম্পূর্ণই থেকে যায়। বরং মড গন চরিত্রটি লেখক যেভাবে তুলে ধরেছেন, তাতে মানসপটে ভেসে ওঠে বিদ্রোহী কবি নজরুলের তেজস্বী কণ্ঠস্বরে গাওয়া, ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা ঝরনার মতো চঞ্চল, মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল’ গানটি। এই ‘মোরা’ যেন মডের নেতৃত্বে আইরিশ জাতীয়তাবাদী দল। কবি নজরুল যেন মড গন চরিত্রটিকেই তাঁর গানে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেই বিদ্রোহী উন্মাদনার পরিচায়ক শব্দগুলো দিয়ে।
সুজিতের চমৎকার সাজানো ঘটনাপ্রবাহে আমরা দেখি, ব্রিটিশ রক্তধারী হয়েও সারা জীবন মড গন আইরিশদের প্রতি নির্যাতনের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করে গেছেন। শুধু তাই নয়, ব্যক্তি মড ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী, নৃত্যকলা, অভিনয়, ফরাসি ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, রান্নাবান্না, শিল্পকলা ও সংস্কৃতিতে গুণান্বিতা। বারবার যৌবনের হাতছানিতে তিনি উন্মাতাল হয়ে উঠলেও কখনোই নিজ আন্দোলন, নীতি ও লক্ষ্যের সঙ্গে আপস করেননি। মড গনের নিখুঁত রূপ, নৃত্যকলা, আইরিশ স্বাধীনতার ঝান্ডাবাহী কর্মকাণ্ড, তাঁকে চিরকাল সমাজে পূজনীয় করে রেখেছে। তাই তো খোদ ইংল্যান্ডের রাজা সপ্তম অ্যাডওয়ার্ড, প্রিন্স অব ওয়েলস থাকাকালে মডকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন তাঁর নৃত্যকলার সম্মোহনী শক্তিতে।
ইয়েটেসের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মড গন তখন সবে প্রথমবার মা হয়েছেন। বিবাহবহির্ভূত সে মাতৃত্ব প্রমাণ করে মডের অনড় লক্ষ্যপথে যাত্রা, দায়িত্বজ্ঞানবোধ এবং ত্যাগী মনোভাবকে। কী দুর্লভ ধাতুতে গড়া ভুবনমোহিনী সে নারী! বিবাহিত পুরুষ লুসিয়েনের সহযোগিতায় মা হওয়া অবিবাহিত মডকে দেখে অন্তত এটা বোঝা যায় যে, কী অদম্য নেশা ছিল তাঁর কাজের প্রতি, তিনি চাননি আর ১০ জন বিবাহিত নারীর মতো ঘরকন্নায় মজে থাকতে। তাঁর উদ্দীপ্ত যৌবন তিনি বিলিয়েছেন আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার কাজে। মড হয়তোবা মা হয়েছিলেন সে বিদ্রোহী রক্তকে ধারণ করে, আরও শক্তিশালী হওয়ার মানসে। ছেলে জন্ম নেওয়ার মাত্র এক মাসের মাথায় তাই তো তাঁকে অন্যের হাতে পালতে দিয়ে নিজ লক্ষ্যে যাত্রা পুনঃস্থাপন করেন মড। বছর না ঘুরতেই মডের সন্তানের মৃত্যু হয়। তিনি নিজেকে যুক্ত রাখেন রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, থিয়েটার জাতীয় কর্মকাণ্ডে। সে বছরই ইয়েটসের সঙ্গে মডের পরিচয় হয় এবং ইয়েটসের গড়া আইরিশ লিটারেরি সোসাইটি ‘হেরমেটিক অর্ডার অব দ্য গোল্ডেন ডওন’ নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত হন। সেখানে চর্চিত জাদুবিদ্যা, অতিপ্রাকৃত, পুনর্জন্ম জাতীয় বিষয়গুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে তাঁর বিশ্বাস জন্মে, ১৮৯১ সালে মেনিনজাইটিসে হারানো একমাত্র ছেলে জর্জকে ফিরে পেতে হলে, তার কফিনের পাশে তার বাবার সঙ্গে আবারও মিলিত হয়ে তাঁকে সন্তান জন্ম দিতে হবে। অবাক লেগেছে এই বিষয়টি যে, মড গনের মতো একজন শাণিত ব্যক্তিত্ব কী করে এতটা কুসংস্কারে বিশ্বাসী হয়ে লুসিয়েনের সঙ্গে আবার মিলিত হয়ে দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দেওয়ার পদক্ষেপ নিলেন? যা হোক, মডের অনুরোধ ফেলেননি লুসিয়েন। মডের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরের হ্যালোইনের রাতে মৃত সন্তানের কফিনের পাশে মিলিত হলেন তাঁরা, বছর ঘুরতেই মডের কোলজুড়ে এল কন্যা ইসল্ট। যথারীতি তাকেও ন্যানির কাছে রেখে আবার শুরু হয় মড গনের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মড বেঁচে থাকাকালে কখনোই মেয়ে ইসল্টকে মাতৃ-পরিচয় দেননি। ইসল্ট বরাবরই সমাজে ‘দত্তক-মেয়ে’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী মেয়ে ইসল্ট হয়তো ঠিকই বুঝতে পারতেন, মড-ই তাঁর মা।
ইয়েটস বা উইলিকে (ডাক নাম) ইসল্ট ও পরিবারের সবাই একজন পিতৃতুল্য অভিভাবক হিসেবেই দেখতেন ও মানতেন। মড ও তাঁর পরিবারের প্রতি ইয়েটসের ভালোবাসা, দায়িত্বশীলতা ছিল বেশ স্বচ্ছ। মডের প্রতি ইয়েটসের অনুরাগ অনুভব করতে পারতেন ইসল্ট। হয়তোবা তাই যখন ইসল্ট দেখলেন চারবার মডের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েও পিতৃতুল্য, পরম পূজনীয় ইয়েটস মডের প্রতিই প্রেমাসক্ত; তখন মাত্র ১৫ বছর বয়সে ইসল্ট কোনো রকম প্রেমের সম্পর্কের দিকে না গিয়ে সরাসরি ৪৪ বছর বয়সী ইয়েটসকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন। হয়তোবা প্রিয় ব্যক্তিত্ব ইয়েটসের এই বারবার প্রত্যাখ্যানের কষ্ট ইসল্ট লাঘব করতে চেয়েছিলেন নিজের প্রেমের ছোঁয়া দিয়ে। ইসল্টের মনে হয়তোবা শঙ্কা ছিল, মার কাছে প্রত্যাখ্যাত, পারিবারিক অভিভাবকসম ইয়েটস পাছে না অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে তাঁদের (মড গন পরিবারের) প্রতি নিজ ভালোবাসার ছায়া সরিয়ে নেন। ইয়েটসও ভালোবেসেছেন ইসল্টকে, কিন্তু তা প্রেয়সী হিসেবে নয়, বরং ইসল্টের মাঝেই ইয়েটস খুঁজে ফিরতেন তাঁর চিরকালের প্রেমিকা মডের অদেখা শুভ্র-স্নিগ্ধ শৈশবকে। তাইতো সাগর তীরে কিশোরী ইসল্টের নৃত্যরত মাধুর্যে মুগ্ধ কবির পঙ্ক্তিতে খুঁজে পাই আমরা সে রকমই চিত্রণ।
সুজিত কুসুম পালের লেখা এই বইয়ের প্রাণপুরুষ উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের শেষ রোমান্টিক কবি। ১৮৬৫ সালে জন্ম নেওয়া ইয়েটস দুর্দান্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অল্প বয়সেই তাঁর অর্জন ছাপিয়ে গিয়েছিল তাঁর সমসাময়িক চারদিকে। ১৯২৩ সালের নোবেলজয়ী, ১৯৩১ সালে অক্সফোর্ড এবং ১৯৩৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করা অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ইয়েটসের প্রেম ভাষা হারায় আইরিশ তরুণ-নেত্রী, মডের উন্মাতাল ভালোবাসায়। মড আমৃত্যু ভালোবেসেছিলেন ইয়েটসকে, কিন্তু সে ছিল আধ্যাত্মিক প্রেম। তাতে ছিল না কোনো শারীরিক সম্পর্ক। মড যদিও বারবার ইশারায় প্রেম জাগিয়ে তুলেছিলেন ইয়েটসের হৃদয়ে, নিজ থেকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, এমনকি চুম্বনও করেছিলেন ইয়েটসকে; কিন্তু ততখানিই। এর বেশি এগোননি, ইয়েটসকেও এগোতে দেননি। ইয়েটসের কবিতা ছিল মডের কাছে তাঁর সন্তানতুল্য, মড নিজেকে বসিয়ে রেখেছিলেন ইয়েটসের কাব্যসম্ভারের পিতৃস্থলে, আর ইয়েটসকে প্রেরণা জুগিয়ে গেছেন চিরকাল আরও নতুন নতুন কাব্যের জন্মদানে। মডের দৃষ্টিতে সে সন্তানের ( ইয়েটসের কবিতা) ওপর থেকে মনোযোগ সরিয়ে অন্য কাউকে দেওয়াটা হতো গোটা পাঠক সমাজকে বঞ্চিত করার সমতুল্য, তাই নিজেকেও নিজে বারবার ধোঁকা দিয়েছেন মড। অন্য পুরুষকে ভালো না বেসেও বিয়ে করেছেন, অন্যের সন্তানের মা হয়েছেন। মডের লক্ষ্য ছিল অনড়। নিজ প্রেম, ভালোবাসার আকুতিকে কখনোই আয়ারল্যান্ডের প্রতি কর্তব্যের আগে স্থান দেননি। ফলে একপর্যায়ে আইরিশদের জন্য স্বাধীন একটি ভূখণ্ড, একটি নিজস্ব পতাকা ও সংবিধান অর্জনে সফল হয়েছিলেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে মড বেশ তড়িঘড়ি পুত্রসন্তান জন্ম দিয়েছিলেন, হয়তোবা সে মাতৃত্বের পেছনে ছিল না কোনো আবেগ, মোহ কিংবা ভালোবাসার তাগিদ। ছিল শুধুই দৃঢ় লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার গাণিতিক ছক। এরপর মডের সম্মোহনী প্রেমের জালে ধরা দিলেন অখ্যাত যুবক কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস। এ জাদুবলয়ে চৌম্বকশক্তির উৎস যতটা না ছিল আইরিশ চেতনাবোধ, তার চেয়ে বেশি ছিল মডের সংগ্রামে সঙ্গী হওয়ার ও তাঁকে কাছে পাওয়ার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা।
সুজিত আমাদের মনে করিয়ে দেন জহির রায়হানের বিখ্যাত বরফ গলা নদীর কথা। আসলেই লেখক সুজিতের তাৎক্ষণিক উপমা, উদ্ধৃতি এবং চিত্রানুগের কলা অসাধারণ! সুন্দর পরিমিতিবোধের নিক্তিতে তিনি অতীব হৃদয়গ্রাহী করে বর্ণনা করেন কীভাবে ৫০ বছরের সাধনার দেবীকে না পাওয়ার বেদনায় প্রসবিত সৃষ্টি সমৃদ্ধ করেছে ইয়েটসের কাব্য ভান্ডার। আর্ট স্কুলে পড়ুয়া দেশপ্রেমিক কবি ইয়েটসের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে আইরিশ লিটারেরি থিয়েটার, যা পরে আব্বে থিয়েটারে রূপ নেয়। তাঁর রচিত গীতিনাট্য, আইরিশ রূপকথা, লোকশিল্পের ঝান্ডাবাহী কবিতা, গান, নাটক তাঁকে সমসাময়িক অন্যদের থেকে ব্যতিক্রমী করে রেখেছে।
সুজিত আরও বলেন, সমসাময়িক রত্নসম অন্য লেখকদের কথা। যেমন এজরা পাউন্ড। পাউন্ড পরে ইয়েটসের ক্ষণস্থায়ী প্রেমিকা অলিভিয়া শেক্সপিয়ারের জামাতা হয়েছিলেন। আবার তারও আগে পাউন্ড এককালে ইয়েটসের খুবই বিশ্বস্ত প্রাইভেট সেক্রেটারিও ছিলেন। অলিভিয়া মারা গেলে তাঁর মেয়ে অসুস্থতার কারণে মায়ের সৎকারে আসতে না পারায় জামাতা পাউন্ডই সব করেছিলেন। তিনি শাশুড়িকে লেখা প্রেমিক ইয়েটসের প্রেমপত্রগুলো সযত্নে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে। কারণ, ইয়েটস চাননি ব্যাপারটা বাকিরা জানুক। এখানেই ফারাকটা পাঠকের নজর কাড়ে। সুজিত খুব সুন্দরভাবে ইয়েটসের সঙ্গে জড়িত নারী চরিত্রগুলোকে পাঠকদের স্বার্থে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন। কারণ, মড গনের প্রতি আসক্তি ইয়েটস আমৃত্যু ধারণ ও প্রকাশ করলেও কবির চেয়ে বয়সে দুই বছর বড় অলিভিয়ার প্রতি শারীরিক আসক্তি, সম্পর্ক, প্রেমপত্র আদানপ্রদান-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় ইয়েটস গোপন রাখতেই চেয়েছিলেন।
ইয়েটসের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা মুগ্ধ করেছিল পাউন্ডকে। অলিভিয়া শিকাগোর ট্রিবিউন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে ইয়েটসের ভূয়সী প্রশংসা করে চিঠি লিখেন ওই পত্রিকার চিত্র সমালোচক হ্যারিয়েট মানরোকে। উল্লেখ্য, মানরোর একটি নিজস্ব পত্রিকা ছিল পোয়েট্রি নামে। এ প্রসঙ্গে অলিভিয়া শেক্সপিয়ারের কথা না বলেই নয়। কিন্তু হলে কী হবে, প্রেম মানে না কোনো বাধা-বারণ! একে একে বারবার প্রিয়া মডের কাছে প্রত্যাখ্যাত, প্রেমপিয়াসী যুবক ইয়েটস অলিভিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ত্রিশের কোঠায় এসে।
সুজিতের বই থেকে জানা যায়, ইয়েটস-অলিভিয়া সংসার বাঁধার মানসে বিছানা পর্যন্ত কিনেছিলেন। কিন্তু অলিভিয়া ক্রমশ উপলব্ধি করেন, শরীরখানা পেলেও ইয়েটসের মনের রানি শুধু একজনই, মড গন। ফলে শিগগিরই অলিভিয়া নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন ইয়েটসের জীবন থেকে।
ইয়েটসের জ্ঞান নিয়ে লেখক সুজিতের বক্তব্য পাঠক সমাজকে মুগ্ধ করে। ইয়েটস কেবল ইংরেজি আর আইরিশ ভাষা নিয়েই তৃপ্ত ছিলেন না। তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর কাব্যভান্ডারের সঙ্গে। তিনি কবিতার আসরে রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদ আবৃত্তি করে শ্রোতাদের তাক লাগিয়ে দিতেন। তাঁর অনুরোধেই রবীন্দ্রনাথ মড কন্যা ইসল্টকে বাংলা ভাষার ব্যাপারে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা এবং প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ইয়েটসের ভারতীয় পুরান, গ্রিক পুরান-সম্পর্কিত জ্ঞান এবং সে জ্ঞানের প্রতিফলনস্বরূপ আমরা পাই লিডা অ্যান্ড দ্য সোআন জাতীয় কবিতা। পৌরাণিক চিত্রকল্প ব্যবহারে ইয়েটস ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইয়েটসের কবিতা দ্য সেকেন্ড কামিং যেন যুদ্ধাহত সৈনিকদের ক্ষতে মলম লাগিয়ে সারিয়ে তুলবার মতো এক মহৌষধ ছিল। ঐতিহাসিক কবিতা চাঙা করে তুলেছিল তাঁদের। তাঁর সে বর্ণনা মনে করিয়ে দেয় ভারতীয় পুরাণের আলোকে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের পালনকর্তা বিষ্ণুকে। ইয়েটসের হিসেবে আমরা দেখি প্রতি সহস্র বছরে ইতিহাসের ঘূর্ণিবলয়ের পরিবর্তনের ছায়ারূপ; যার উদাহরণ বয়ে চলেছে এথেন্সের পরিবর্তনের ঠিক সহস্র বছর বাদে বাইজেন্টিয়ামের সাংস্কৃতিক জাগরণ এবং তার ঠিক সহস্র বছর পরই ইতালির রেনেসাঁ। তাঁর দুঃস্বপ্নের ‘রাফ বিস্ট’ আলুথালু হয়ে যেদিকে এগোচ্ছে, সেখানেই একদা জন্মেছিলেন বাইবেলের যিশু। ইয়েটস তাই আশাবাদী ছিলেন আবার সেই বেথলেহেমে নতুন এক অবতারের আগমনের।
সর্বশেষে আলোকপাত করছি লেখক সুজিতের কল্পনায় আঁকা বাস্তব ইয়েটস-সহধর্মিণী জর্জিকে নিয়ে। সে আরেক চমক! সে ত্যাগ, সহনশীলতার বিকল্প শুধু সেই, স্বামীর মনটুকু পাওয়ার জন্য যিনি নিজের আজন্মলালিত নামটুকু পর্যন্ত সানন্দে ত্যাগ করেছিলেন স্বামীর ইচ্ছাপূরণে! পরিণীত হয়েছিলেন জর্জি থেকে জর্জ-এ। ২৪ বছরের উত্তাল যৌবন নিয়ে জর্জি ৫২ বছর বয়সী ইয়েটসের সঙ্গে ঘর বেঁধেছিলেন। সে সম্পর্কে প্রেম কি আদৌ ছিল? তবে এখানে সত্যি সমালোচনার লোভটুক সংবরণ করা পাঠকমাত্রই দুষ্কর। হানিমুনকক্ষেও কবি ও কবিপত্নীর কক্ষে অহর্নিশি বসত করেছে মড ও মড-কন্যা ইসল্টের স্মৃতি। সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর সামনে বসেই ইয়েটস বুনেছেন তাঁর অন্য প্রেমিকাকে নিয়ে! এ নিশ্চয়ই নির্মম! কিন্তু হয়তো সেদিনের জর্জির সেই ত্যাগের কারণেই আজ আমরা আস্বাদন করতে পারছি ইয়েটসের অমূল্য কাব্যভান্ডার, জর্জিকে বিয়ের পর থেকেই ইয়েটসের কাব্যাকাশে নিয়ত পর্যবেক্ষিত হয়েছিল পূর্ণিমার পুরোনো চাঁদ। ৫২ বছর বয়সী ইয়েটস মূলত বিয়ে করেছিলেন শুধু সন্তানের আশায়। শুধু দুটো সন্তানই নয়, জর্জির সান্নিধ্যে আসার পরই ইয়েটস পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার, রাজনৈতিক মর্যাদাসহ আরও অনেক সার্থকতা।
সর্বোপরি পর্যবেক্ষণে এটাই দেখা যায়, ইয়েটসের কবিতাগুলো ছিল খুবই জীবনঘনিষ্ঠ, আর সে জীবনের উপাত্ত ছিল কিছুটা রাজনৈতিক, কিছুটা পৌরাণিক কল্পকাহিনিভিত্তিক। তবে ছিল মূলত রোমান্সে ভরা। আর সেসব কবিতার প্লটগুলো গড়েছিল তাঁর জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা নারী, যারা সবাই ছিলেন নিজ নিজ গুণে গুনান্বিতা, তাঁরা কেউ কাউকে ওপরে উঠবার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেননি। বিলিয়েছেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, অকৃত্রিম সৃজনশীলতার উপাত্ত।
কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত সুজিত কুসুম পাল সাহিত্যপ্রেমিক ও গবেষক। তাঁর চমৎকার শব্দ বুননে উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস নতুন করে যেন প্রাণ পেল বাঙালি পাঠক হৃদয়ে। তাঁর শব্দচয়ন, উপমা, সাযুজ্যের ব্যবহার, অন্যান্য ইংরেজ কবি, বাংলা সাহিত্যের কবি, সবার সৃষ্টির সঙ্গে তুলনামূলক উদাহরণ তৃষ্ণা নিবারণ করেছে পিপাসু পাঠকচিত্তের। অনেক অজানা, দুর্লভ তথ্যে অলংকৃত এই বইটি সাহিত্যপ্রেমীদের মনের খোরাক মেটানোর জন্য একটি অমূল্য ভান্ডার হিসেবে নিঃসন্দেহে জায়গা করে নেবে পাঠক-হৃদয়ে। একটি অমূল্য গ্রন্থ পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়ায় টরন্টোর বাঙালিদের সাহিত্য সংগঠন বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।