ইকবাল হাসান : বন্ধু আমার

সৈয়দ ইকবাল

আমরা আসলে এক কয়েনের দুই দিক। শুধু নামেই নয়, দীর্ঘ জীবনের পদে পদে পরস্পর একে অন্যের জীবনে ওভারলেপ করেছি। ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম শুরু করা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার আমরা দু’জন পাই ২০১৫ সালে। বইমেলার লেখক কুঞ্জের আড্ডায় আহমাদ মাযহার হাসির ছলে বলে ফেলেছিলেন – এবার ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার পেলেন সৈয়দ ইকবাল হাসান। ক’দিনে মেলায় ছড়িয়ে গেছে মাযহারকৃত আমাদের দু’জনের নাম এক করা স্যাণ্ডউইচ। পরে দেখি পত্র-পত্রিকায় পুরস্কার প্রাপ্তির খবরাখবরে অনেকে লিখেছেন সৈয়দ ইকবাল হাসান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর উত্তাল স্রোতে নিজদের শক্তভাবে দাঁড় করানোর বাসনা নিয়েই দেশের নানা ছোট বড় শহর থেকে ঢাকায় আসা সত্তর দশকের লেখক কবি আমরা। আমাদের আগে ষাট দশকের সবাইকে মুরব্বী মানতাম। সমীহ করতাম। তবে, কেউ অনুকরণ করতাম না।

আমি চট্টগ্রাম থেকে। ইকবাল হাসান বরিশাল থেকে। আরো অনেকে অন্যান্য শহর থেকে এসেছেন। যেমন : আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আতাহার খান আরো কতজন। আবার ঢাকাবাসী ইমদাদুল হক মিলন, আবু সাঈদ জুবেরী, বশীর আহমেদ, তাপস মজুমদার, ফিউরী খোন্দকার, সিরাজুল ইসলাম, বারেক আবদুল্লাহ সহ আরো অনেকে আমাদের সত্তর দশকের লেখক কবি যোদ্ধা। সবাই আমরা নিজ দায়িত্বে নিজে জীবন টেনে নিয়ে এগিয়েছি গল্পকার হতে, কবি হতে। প্রাণপণ জীবনযুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম লেখক হয়ে বিকশিত হতে। অন্যদের চেয়ে আমার ছিলো একটু আলাদা প্রেসার। লেখার সঙ্গে আঁকাকেও জীবনে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে মেনে নিতে হয়েছিলো। একদিকে গদ্য লেখা, অন্য দিকে বইয়ের প্রচ্ছদ, শিশু কিশোরদের বইয়ের অলংকরণ করে যা প্রাপ্তি হয় লাভ।

দুই বন্ধু ইকবাল হাসান এবং সৈয়দ ইকবাল
দুই বন্ধু ইকবাল হাসান এবং সৈয়দ ইকবাল

ইকবাল হাসান শুরু থেকেই কবি। তবে, তার গদ্যের হাতও দারুণ। পরে গল্পকার হিসেবে সুনাম করেছে। ইত্তেফাক তখন খুবই জমজমাট। প্রথম সারির প্রথম পত্রিকা। মালিকগণ বরিশালের হওয়াতে বরিশালের মানুষের কিছুটা সুবিধা হতো। ইত্তেফাকের সাপ্তাহিক সিনে পত্রিকা ‘পূর্বাণী’ তে ইকবাল হাসানের সাংবাদিক হিসাবে কাজ হয়ে গেলো। আমরা অন্যরা থিতু হতে, একটা কাজের জন্যে তখনও হন্যে হয়ে ঘুরছি।

ইকবাল হাসানের আরেক ভালো গুণ, সেই আদিকাল থেকেই নিজে একটু দাঁড়াতে পারলে বন্ধুদেরও ও টেনে তুলতে চায়। পূর্বাণীতে কাজে ঢুকেই অর্ধপৃষ্ঠা তখনকার আপকামিং গল্পকারদের ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছাপলো। ইমদাদুল হক মিলন, তাপস মজুমদার, বারেক আবদুল্লাহ এবং আমার,। তখন ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছাপা হলে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতো। সারা দিনরাত যেন আকাশে ভাসছি, এমন মনে হতো!  আসলে বোঝাতে চাইছি ইকবাল হাসান একই বয়সের হয়েও নিজে সুযোগ না নিয়ে বন্ধুদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতো। ওকে ঈর্ষাও হতো।  যখন বলতো, আজ ববিতার, কাল সুচন্দা, জয়শ্রী কবীরের ইন্টারভিউ নিতে তাদের বাড়ি গেছে। তারা কত কিছুই না খাইয়েছে তরুণ সুদর্শন সিনে সাংবাদিককে। অন্যান্য সিনে সাংবাদিকের চেয়ে ইকবাল হাসানতো অগ্রসর হবেই। যেহেতু সে একজন কবি। তাই কথায় বার্তায় তাকে তারকাগণ খুব পছন্দ করতো। তখনকার নায়িকা ও নৃত্যশিল্পী বড় বড় চোখের অপরূপ অঞ্জনা সাহাকে আমার খুব ভালো লাগতো। সিনেমা কিংবা সিনে পত্রিকায় দেখা ছাড়া আমার মত সাধারণ জনের এদের এদের দেখার আরেক সহজ উপায় স্বপ্নে দেখা। ইকবাল হাসান শুনে হাসতে-হাসতে আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেলো অঞ্জনার বাড়ি। তাদের কত কথা, ঠান্ডা পানীয়, মিষ্টির রকমারী সামনে নিয়ে। বেশ দুই একবার আলাপও করিয়ে দিলো শিল্পী গল্পকার বন্ধু হিসেবে আমাকে। প্রায় আধ ঘন্টা পাঁচটি রসগোল্লা মুখে পুরলাম। তবে, একটি শব্দ বা কথা বলার শক্তি পেলাম না, কিংবা সাহস হলো না। এমনকি অঞ্জনা সরাসরি আমার চোখে তাকিয়ে ইকবাল হাসানকে বলে ছিলেন – এই, আপনার বন্ধু বোবা নাকি?

২০২০ সালে বরেণ্য সম্পাদক আবুল হাসনাতের মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে এনআরবি টেলিভিশনের কানাডা জার্নালের আয়োজনে কথা বলেন কবি ইকবাল হাসান এবং অন্যেরা।

বন্ধু আমার দমকা হাসিতে কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। দৃশ্যটি মনের ফ্রিজে  আজীবনের জন্য রেখে দিয়েছি। মাঝেমধ্যে এখনো চোখে ভাসে।

ওর ভালোবাসা ও নৈকট্য পাওয়ার কিছু কারণ আছে। প্রথমত একই নাম। দ্বিতীয়ত গড়ন, উচ্চতা মুখাবয়বের ধাঁচ প্রায় কাছাকাছি। যৌবনে পাশাপাশি দাঁড়ালে অনেকে ভাই মনে করে বসতেন। পরে দেখি জীবন প্রবাহও অনেকভাবে মিলে যেতে লাগলো। সে বরিশালের স্বনামধন্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুন্দরী কন্যা তাসলিমা হাসানকে বিয়ে করলো। তার শিক্ষাদীক্ষা স্মার্টনেসের সঙ্গে বেশ মানানসই।

ভেতরে ভেতরে কেমন এক হীনমন্যতায় ভুগতে লাগলাম। তখনো নারীজাতী জীবনে আসেন না ঠিক তা নয়! তবে ইকবাল হাসানের মত সম্ভ্রান্ত বাড়ির অপরূপ নারী আমার মত ছন্নছাড়া পরিবার বহিস্কৃত সামান্য আঁকিয়ে লেখককে কেন বিয়ে করবে। তবে অবাক করে ঘটলো বন্ধুর মতই ঘটনা। পুরোনো ঢাকার আদিসম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের কন্যা কপালে জুটলো! যার বাপ-দাদা-জ্যাঠাদের নামে ঢাকা শহরের সড়কের নাম দেয়া আছে।

বন্ধু ইকবাল হাসানের ঘরে চাঁদের মত ফুটফুটে কন্যা সন্তান এলো। আমার ঘুম হারাম। আহা ! কী সুন্দর কন্যার পিতা বন্ধু আমার। আমারও ওর মত ফুটফুটে কন্যা সন্তান চাই!

চায় তো সবাই-ই! চাইলেই সব হয় না! আমার বেলায় কিন্তু চাওয়াটাই সত্যি হলো। ফুটফুটে কন্যা সন্তানই এলো বন্ধুর মত।

নানা জীবনযুদ্ধ পেরিয়ে আমরা দু’জনই যখন ঢাকায় ভালোই থিতু হয়ে উঠছি। বেশ একটু নামটামও হয়েছে লিখে ঠিকে। ইকবাল হাসান ইত্তেফাকে জমিয়ে আছে। আমিও প্রথম সারির বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে সিনিয়ার আর্ট ডিরেক্টর হয়ে উঠেছি। স্ত্রীও বিশ্বব্যাংকে কাজ করছে। কন্যাটি গ্রীন হেরাল্ড স্কুলে ও লেভেলের দিকে ছুটছে। বাড়তি পাওয়া হলো একুশে টিভিতে নাটকে অভিনয় করে সবার প্রিয় ছোট্ট অভিনেত্রী হয়ে উঠেছে মেয়ে।

সাহিত্যের ব্যাপারেও রাহাত খান, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আনিসুজ্জামান, আসাদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নির্মলেন্দু গুণ আরও কত অগ্রজদের হাত মাথায় অনুভব করি আমরা দুই বন্ধু।

এমন সুসময় কেউ উধাও হয়!

ইকবাল হাসান হলো। সঙ্গে ইমদাদুল হক মিলন। এদিক খুঁজি, ওদিকে খুঁজি। কই বন্ধু আমার! নেই, নেই কোথাও নেই! পরে শুনলাম তখন জার্মানিতে যাওয়ার একটা জোয়ার এসেছিলো। বন্ধু সেই জোয়ারে ভেসেছেন। মাত্র ছয় কিংবা আট মাস পরে বন্ধু ইমদাদুল হক মিলনের ঢাকায় প্রত্যাবর্তন। সে সাথে করে নিয়ে এলো মহা মূল্যবান প্রবাসে থাকার অভিজ্ঞতা। প্রবাস জীবন নিয়ে লিখে ফেল্লো বাংলা ভাষায় আরেকটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘পরাধীনতা’। আমাকেও জোর করে লেখালো  প্রথম উপন্যাস ‘ভালোবাসার পাঁচ পা’। রাহাত খানের তত্ত্বাবধানে রফিক আজাদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘রোববার’-এর ঈদ সংখ্যায় দু’টি উপন্যাস ছাপা হয়েছিল।

দিন যায়, মাস বছর যায় বন্ধু আমার আর ঢাকায় ফেরে না! বুঝিয়ে বলা যায় না কেমন যেন ফাঁকা লাগতো!খুব মিস করতাম তাকে। একদিন খবর পেলাম জার্মানি থেকে বাহামা,  সেখান থেকে ইউএস ঘুরে ইকবাল হাসান কানাডার টরন্টো শহরে থিতু হয়েছে।

দুঃখ হচ্ছিলো আর বন্ধুর সাথে তেমন দেখা হবে না। যারা দেশ ছেড়ে একবার প্রবাসে চলে যায়, তারা আধা জীবন্ত মানুষ আর আধা মরা ফ্রোজেন মাছ হয়ে যায়! আমার এই জীবনের বিন্দুমাত্র বাসনা ছিল না। অবশ্য তা থাক আর নাইবা থাক নিয়তির ঘটন ঘটেই থাকে!

আগেই বলেছি বন্ধু ইকবাল হাসানের সঙ্গে আমার অদৃশ্য একটা দড়ি বাঁধা রয়েছে মনে হয়। নয়তো আমার স্ত্রীর সাজানো সংসার ফেলে নিজের ছোট ভাইবোনের টানে কানাডার ইমিগ্রেশন নিয়ে এসে টপকে পড়তে হবে মন্ট্রিয়লে! ফরাসি কচকচানিতে অর্ধেক মগজ ঘোলা করে শেষ অব্দি টরন্টো শহরে। যে শহরটি ছিল তখন ইকবাল হাসানের শহর। আবার বন্ধুর শহরে নাজিল হলাম। সেই নব্বই দশকের শুরুর দিকে শুধু নিজের সাহিত্যই নয়, টরন্টোর বাঙালি সমাজের সাহিত্য অনুষ্ঠান, প্রকাশনা, সব কিছুতেই ইকবাল হাসানের প্রতিপত্তি ছিলো তুঙ্গে। আমাকে যেখানেই নিয়ে গেছে সে, আমি সমাদর পেয়েছি। আবার পাশাপাশি কাছাকাছি জীবনের ঘষাঘষি। হুহু করে ক্যালেন্ডর উল্টে যুগের পর যুগ কাছাকাছি কেটে গেলো।

২০২২। এই বছরই আবার ঢাকায় একুশে বইমেলায় গেলো। টরন্টো ছাড়ার আগে নিমোনিয়া বাঁধিয়ে হাসপাতালে পর্যন্ত তাকে থাকতে হয়েছিলো। তবু চলে গেলো ঢাকা। এবং যথারীতি যা হওয়ার তাই হলো। প্রাণের বইমেলার ধুলোবালি তার প্রাণে টান দিলো। ধরলো। এতই অসুস্থ হলো, ফুসফুসে ক্ষতি এতটাই হলো যে, ১৩ দিন এভার কেয়ার হাসপাতালের আইসিইউ থাকতে হলো তাকে। আমি গিয়েছি বন্ধুকে দেখতে কয়েকবার। আইসিইউর বেডে নলমল লাগানো অবস্থায় দেখে ভেতরে ভেতরে ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো বন্ধুর আর কানাডায় ফেরা হয় কী না! তবে, তার প্রাণশক্তি নর্থপোলের কাছের জায়গা ইয়োলো নাইফের আদিবাসীর চেয়েও শক্ত। অন্য এয়ার ওয়েজ তাকে আকাশে তুলুক আর নাইবা তুলুক বাংলাদেশের জাতীয় বিমান টরন্টো সার্ভিস চালু করতেই প্রথম ফ্লাইটে অক্সিজেন নাকেমুখে চেপে সে টরন্টো ফিরে এসেছে। যদিও আসার পর হাসপাতালে সপ্তা খানেক সেবা নিতে হয়েছে। এখন তার আইসক্রিম লেনের বাড়িতেই আছে। গেলে দেখা হয়। ঘুমিয়ে থাকলে দেখেই ফিরে আসি। জেগে থাকলে কথা বলি। সর্বদা কামনা করি বন্ধু আমার নিজ প্রাণ শক্তিতেই ভালো হয়ে উঠুক।

আমার সেই বন্ধু ইকবাল হাসান ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল সকল পার্থিব চাওয়া-পাওয়ার বাইরে চলে গেল।