আকবর হোসেনের ‘অনুভবের বিভূতিতে’ ঐশ্বরিক ভাবনার স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা
সামিনা চৌধুরী
‘আত্মপরিচয়’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘যেটা লিখিতে যাইতেছিলাম সেটা সাদা কথা, সেটা বেশি কিছু নহে – কিন্তু সেই সোজা কথা, সেই আমার নিজের কথার মধ্যে এমন একটা সুর আসিয়া পড়ে, যাহাতে তাহা বড় হইয়া ওঠে, ব্যক্তিগত না হইয়া বিশ্বের হইয়া ওঠে।’ মহৎ সাহিত্যকর্মগুলি অনেক সময়ই লেখকের ব্যক্তিগত গল্প। কিন্তু সেই গল্প বলার দক্ষতা ও দর্শনের বিচারে সেটি মহৎ সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠে। আকবর হোসেনের ‘অনুভূবের বিভূতিতে’ গ্রন্থটিতে তাঁর নিজের জীবন ও কাছাকাছি থাকা মানুষদের জীবনের গল্পের দার্শনিক প্রকাশ ঘটেছে। লেখকের জ্ঞান, প্রজ্ঞা , উপস্থাপন-কৌশল ও ভাষা দক্ষতার কারণে এইসব ব্যক্তিগত ঘটনাগুলি হয়ে উঠেছে নৈর্ব্যক্তিক। জীবন চলার পথে আশেপাশে ঘটে যাওয়া ছোটো ছোটো ঘটনার প্রেক্ষিতে গভীর দর্শন ভাবনা নিয়ে লেখা নিবন্ধের সংকলন এই বই, যা পাঠককের সামনে খুলে দেবে এক নতুন অনুভূতির দরজা।
প্রাচীন ভারতীয় দর্শন শাস্ত্র বিষয়ে আকবর হোসেনের বিশাল পড়াশোনার প্রতিচ্ছবি তাঁর অসামান্য এই বইটিতে পাওয়া যায় । ‘বিদ্যতে আনেন ইতি বেদ’ নিবন্ধটিতে তিনি পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ বেদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। খুব সহজ করে আলোকপাত করেছেন বেদের সৃষ্টি, বেদ সংকলনের ইতিহাস, বেদের শাখাসমূহ, কৃষ্ণদ্বৈপায়ণসহ অন্যান্য ঋষিদের কার্যপ্রণালী, বেদ প্রদত্ত রীতিনীতি এবং তার ক্রমবিবর্তন। বেদের চারটি শাখার বিষয়বস্তু খুব সংক্ষেপে পাঠক জানতে পারবেন এই বইটি থেকে, বুঝতে পারবেন মানব জীবনের প্রতিটি কর্মের জন্য বেদের নির্দেশনা রয়েছে। লেখকের ভাষায়, ‘বেদ একটি প্রাচীন বাস্তব-সম্মত জ্ঞানধারা যা কৃষি থেকে পরমার্থ পর্যন্ত বিস্তৃত’।
প্রাচীনতম এই গ্রন্থটির বিজ্ঞান সম্মত প্রমাণাদি বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক বলেছেন, ‘বেদ ঋষিদের কল্পনাবিলাসের প্রকাশ মাত্র নয়, সমগ্র জাতির বহু শতাব্দীর অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্বিক প্রত্যক্ষ অনুভূতির প্রামাণ্য ইতিহাস।‘ বেদের মানবিক দিক আলোচনা করে আকবর হোসেন ব্যাসদেবের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী স্মরণ করেছেন, ‘ন মানুষাৎ শ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ’ যেটি পরবর্তীতে বড়ু চন্ডিদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ ; এবং নজরুলের ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’ রূপে উচ্চারিত হতে দেখেছি আমরা।
‘মহাভারতের কথা’ নিবন্ধে মহাভারত বিষয়েও তার অগাধ পান্ডিত্যের প্রমাণ রয়েছে। মহাভারত নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি ‘দ্যা রাইজ এন্ড ফল অফ রোমান এম্পায়ার’-এর লেখক এডওয়ার্ড গিবসনকে উল্লেখ করে বলেছেন, মহাভারত যতটা ইতিহাস তার চেয়েও বেশি সাহিত্য, তার চেয়েও বেশি জ্ঞান।
গীতা থেকেও আকবর হোসেন অনেক উদ্ধৃতি দিয়েছেন বইটিতে। ‘আজ যা শিখলাম’ নিবন্ধে ‘একটি জলজ্যান্ত মানুষ মরে গেলে তার হাসি কান্নার অনুভব কোথায় যায়’? – এই প্রশ্নের অবতারণা করে তিনি গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ের উল্লেখ করেছেন।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে আকবর হোসেনের পিতৃবিয়োগ হয়। মাকেও খুব অল্প বয়সে হারান। হারিয়েছেন পিতামহসহ আরও অনেক আত্মীয়-বন্ধু। আর এসব কারণেই হয়তো মৃত্যু বিষয়টি আকবর হোসেনের কাছে খুব স্বাভাবিক। তার লেখাগুলি থেকে জানা যায় যখনই তিনি কোনো সমাধিভূমি পরিদর্শন করেন, তার মনে আসে গভীর ভাবনা। এই শিক্ষাটি হয়তো তিনি তাঁর মায়ের কাছে পেয়েছিলেন। ‘আজকের দেখা শোনা’ নিবন্ধে তিনি তাঁর মায়ের উল্লেখ করে বলেছেন, ছোটোবেলায় তিনি কবরস্থানকে ভয় পেতেন, তখন তাঁর মা অভয় দিয়ে বলতেন, ‘সেখানে সব শান্ত আর প্রশান্ত’। বইটির ‘জীবন বেদের নানা অধ্যায়’ নিবন্ধে তিনি একজন ঋষির উল্লেখ করে বলেছেন, মানুষ শুধু শুধু মৃত্যুকে ভয় পায়। জীবনের সব কাজ শেষ হয়ে গেলে আর কী করার থাকে! মরে গেলে মানুষের জাত, ধর্ম, আপনজন, ঠিকানা, ভালবাসা কেউ থাকে না। মৃত্যুর মত মুক্তি আর কেউ দিতে পারেনা … পড়তে পড়তে পাঠককের মনে হবে লেখক আকবর হোসেন যেন গ্রিক মিথলজির টিথুনাস। ভোরের দেবী অরোরার ভালোবাসার কল্যাণে অমরত্ব লাভ করেছিল টিথুনাস , কিন্তু চিরযৌবন লাভ করতে পারেনি। প্রতিদিন মৃত্যু কামনায় সে বলতো, ‘Let me go: take back thy gift’. বইটির ‘জীবন বেদের নানা অধ্যায়’, ‘প্রথম দেখা মৃত্যু’, ‘এক রাতের অভিজ্ঞতা’, ‘আসা যাওয়ার পথের ধারে’ প্রভৃতি নিবন্ধগুলিতে জীবন মৃত্যুর যে সূক্ষ্ম সীমায় মানুষ জীবনযাপন করে, সেই অনুভূতি পাবেন।
‘শ্যামলিমায় ঈশ্বর’ নিবন্ধে আকবর হোসেন লিখেছেন, ‘তেজোদীপ্ত যৌবনে যখন বিশ্বময় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়েছিলাম তখনই আকাশে কোন সুবর্ণ খচিত সিংহাসনে বসা ঈশ্বরে অবিশ্বাস জন্মেছিল যা আজও আমার মননে বিদ্যমান।‘ বইটিতে এই বিষয়ে তাঁর সুগভীর চিন্তা, দর্শন এবং অন্যান্য মনীষীদের ভাবনা লিখেছেন। লেখকের মতে ঈশ্বর আছেন, না নেই, এই মীমাংসা আজ পর্যন্ত করা যায়নি কারণ ঈশ্বরকে কেউ দেখেনি। কাজেই সে অনুসন্ধানে না গিয়ে লেখক উপনিষদের মতে বিশ্বাস করে বলেছেন, ‘তুমি নিজেকে জান তাহলেই পরম সত্তাকে জানতে পারবে।‘ লেখক একজন সাধুর উপদেশ মনে করে বলেন যে, মালা জপার সাথে জীবনের ধ্রুব সত্য সন্ধানের কোনো সংযোগ নেই । এদিকে ‘ধর্মের সরল আদর্শ’ প্রবন্ধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিরীশ্বরবাদী না হয়েও বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘এমনি আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই ধর্মকেই মানুষ সংসারের সর্বাপেক্ষা জটিলতা দ্বারা আকীর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে।‘ এইসব দর্শন, দ্বন্দ্ব, তত্ত্ব আর নিজের ভাবনার ফলেই লেখকে নিজেকে নিরীশ্বরবাদী বলেছেন।
আকবর মনে করেন আলোকিত ঈশ্বরের ঘরে আজ অনেক অন্ধকার জমা হয়েছে বলেই ধর্মের কারণে মানব ইতিহাসে অনেক রক্তপাত হয়েছে। এখনও সেই হানাহানি চলছেই এবং এটা বন্ধ করা প্রয়োজন। লেখক এটাও মনে করেন যে ধর্মের উদ্দেশ্য যদি হয় একজন মানুষকে ভালো মানুষ বানানো তবে বিশেষ কোনো ধর্ম অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই। তাঁর মতে, সন্তানদের বিশেষ কোনো ধর্মের বাধ্যতামূলক শিক্ষা তাদের সহজাত বিচার বিবেচনাকে, তাদের চিন্তার স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্থ করে। জর্জ বার্নাড শ’র উক্তি উল্লেখ করে ‘আমার ধর্ম’ নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তি সম্পর্কে সাবধান যার ঈশ্বর আকাশে বাস করে।‘ কাজেই বলা যায়, নিরীশ্বরবাদ জ্ঞানের উদারতার সাহসী প্রকাশ, সেখানে মানুষই ভগবান। এ প্রসঙ্গে সুব্রত কুমার দাসের অনুবাদে নেপালি কবি বলাকৃষ্ণ সামার ‘মানুষ সোয়ায়াম দেবতা হুনচা’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘যে মানুষ মানুষকে মানুষ ভাবে/সে হলো শ্রেষ্ঠ মানুষ/ আর মানুষে যে ভগবান দেখতে পায়/সে আসলে নিজেই ভগবান।‘
অনুভবের বিভূতিতে’ বইটিতে প্রেম বিষয়ক কিছু নিবন্ধ আছে। আকবর হোসেনের মতে প্রেম সুন্দর, সরল, চিরস্থায়ী। বইটির প্রথম নিবন্ধে একজন নিরঞ্জনের কথা আছে যিনি তার পূর্ব প্রেমিকার কন্যাদ্বয়কে পিতৃস্নেহে পালন করছেন যদিও তার সেই প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হয়েছিল এবং কন্যাদ্বয় সেই স্বামীর ঔরসজাত। ‘বিচিত্র সৃষ্টির আনন্দ’ নিবন্ধটিতে তিনি একটি দম্পতির গল্প বলেছেন, যেখানে নারীটি মুক ও বধির। ‘কমলিনী কেন অভিমান করে’ নিবন্ধে যুগে যুগে নারীর প্রতি পুরুষের অপরিসীম ভালবাসার ইতিহাস তুলে ধরে নারীবাদ ও পুরুষবাদের বৈষম্য নিয়ে নিজের ভাবনা দিয়েছেন। বইটির ‘পরিতাপে পরিত্রান’ ,’শোভার কথা’, ‘অসম্ভব’, ‘গিন্নির বকাঝকা’ প্রভৃতি নিবন্ধগুলো মানব-মানবীর প্রেম নিয়ে লেখা। ‘নৈতিকতার তুলাদন্ড’ নিবন্ধে আকবর হোসেন নারী পুরুষের বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ককে নিরুৎসাহিত করেছেন। ‘বিবাহ কি একটি চুক্তি মাত্র?’ নিবন্ধে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যৌন মিলনই কি বিবাহের একমাত্র উদ্দেশ্য? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে জগতের কোটি কোটি বিবাহিত দম্পতির জৈবিক প্রয়োজন যখন স্থিমিত হয়ে আসে অথবা থাকে না তারা কেন একত্রে থাকে?’ রবীন্দ্রনাথ ‘উৎসব’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে ভয়কে যদি কেহ সম্পূর্ণ অতিক্রম করিতে পারে, বিপদকে তুচ্ছ করিতে পারে, ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করিতে পারে, মৃত্যুকে উপেক্ষা করিতে পারে, তবে তাহা প্রেম।‘ লেখক আকবর হোসেন এই বিশুদ্ধ প্রেমে বিশ্বাসী। প্রেম পরিণয় পর্যন্ত না গড়ালেও প্রেম থেকে যায় নিখাদ সোনার মত। ‘সময়ের দাঁড়ি ও কমা’ অংশে চিরকুমারী অর্চনা দিদির প্রাক্তন প্রেমিকের ভালবাসার গল্প বলেছেন যেই প্রেমিক অর্চনা দিদিকে বিয়ে করেননি, কিন্তু অর্চনা দিদির মৃত্যুর পর পরম মমতায় তার শবদেহ কাঁধে নিতে এসেছিলেন।
আকবর হোসেন প্রচণ্ড জীবনমুখী একজন মানুষ। জীবনের প্রতি তাঁর ধনাত্বক মনোভাবের কারণেই হয়তো-বা তিনি তাঁর অফিসের এম্বাসেডর হয়েছিলেন, যাকে অন্য সহকর্মীরা তাঁদের জীবনের কোনো সমস্যার কথা বলে হালকা হতো। ‘বিচিত্র চিন্তা’ নিবন্ধে তাঁর কন্যা পিতামাতা বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে যখন অনুযোগ করে মন খারাপ করছে তখন লেখক বাইরে সাদা ফুল ফোটা এক মহীরুহের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন যদিও এই ফুলগুলোর আয়ু মাত্র এক সপ্তাহ, তবু ক্ষণিকের জীবনে কী অফুরন্ত আনন্দ। মানব জীবনেও তো সে আনন্দ থাকা উচিত।
সাধারণত যে সকল দর্শন সাহিত্য বা প্রবন্ধ বা নিবন্ধ মৃত্যু, ঈশ্বর, স্মৃতি ইত্যাদি বিষয়ে লেখা হয়, সেগুলোতে একটা দুঃখের সুর থাকে। কিন্তু আকবর হোসেনের বইটিতে সেই গভীর বিষাদ নেই। জীবনকে ভালোবাসার, জীবনকে সুন্দর করার মন্ত্র আছে। তাঁর ‘ধুন’ নিবন্ধে তিনি বলেন, বেঁচে থাকার জন্য একটা ‘ধুন’ চাই। ‘ধুন’ হলো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। অনন্ত আকাশের হাজার লক্ষ কোটি তারা, নীহারিকা, ছায়াপথ, এই সবকিছুকে আমরা যদি একই দৃষ্টিতে দেখি, তাহলে ওই তারাদের মতো মানুষও একা ছুটে চলে। লেখকের মিনতি দিদি বলেছিলেন, ‘ওরে পাগল, বেঁচে থাকলেই কি জীবন হয়!’ অমৃতের সন্তান মানুষের গভীর জীবনবোধ থাকতে হয়। জন্ম-মৃত্যুর মাঝের কিছু সময় সব প্রাণীরই কেটে যায় ।
অসামান্য ভাষা দক্ষতার মাধ্যমে অনুভূতি ও দর্শনের প্রকাশ গ্রন্থটিকে সহজতর এবং সুখপাঠ্য করেছে। ‘কবিতার কথা’ নিবন্ধে লেখক নিজেই লিখেছেন, ‘কবি নানা রকমের উপমা আর শব্দ চযন করেন যার সাথে বাস্তবের কোনো তুলনা হয় না, কিন্তু পাঠকের চেতনাকে উস্কে দেয়।‘ আকবর হোসেনের প্রতিটি ছোটো ছোটো বিষয়ে লেখা অনুভূতিগুলি যেন একেকটা কবিতার মতো যা পাঠককে ভাবতে শেখায়। গদ্যকারে লেখা তাঁর এইসব রচনায় ছন্দ মাত্রার কোনো ব্যাপার নেই, নেই উপমা বা শব্দ চয়নের বাধ্যকতা, নেই রূপকল্প তৈরির চেষ্টা কিন্তু অপূর্ব প্রাঞ্জল সেই গদ্য শুধু লেখকের ভাষার গুণে কবিতা হয়ে উঠেছে। একটা কবিতা যেমন অনেকবার পড়লেও তার আবেদন শেষ হয় না, আকবর হোসেনের লেখাগুলোও তেমনি বহুবার করে পড়া যাবে এবং প্রতিবারই মনে হবে কী নিগূঢ় এই দর্শন ভাবনা! আর এসব কারণেই এই বইটি পাঠক সংগ্রহে রাখবেন বলে আশা করি।
বইটির প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপে লেখক লিখেছেন, ‘আমার স্মৃতিশক্তি প্রবল বিধায় আমি বহু পূর্বে দেখা জিনিসকেও হুবুহু মনে রেখেছি।‘ এই বিষয়টার প্রমাণ পাই তাঁর অসংখ্য কবিতার উদ্ধৃতি দেখে। তাঁর সুবিশাল পাঠাভ্যাস আর স্মরণশক্তির কারণে বইটিতে তিনি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শেক্সপিয়র, গীতা, বেদ, উর্দু সাহিত্য ও আরও বিভিন্ন উৎস থেকে অসংখ্য উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন যা বইটিকে আগ্রহোদ্দীপক করেছে।
লেখক এটাও বলেছেন, ‘আমি বানিয়ে গল্প লিখতে পারি না বলে যা দেখেছি তাই আমার লেখার প্রতিপাদ্য বিষয়।‘ অর্থাৎ এই বইয়ের সকল পাত্রপাত্রীগন লেখকের পরিচিত এবং প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে লেখকও জড়িত ছিলেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বইটি কিছুটা আত্মজৈবনিক দর্শন বলা যায়। বইটি যেন আকবর হোসেনের ডায়েরির পাতাগুলির সংকলন। নিবন্ধগুলির রচনাকাল মার্চ ১৯৮৯ থেকে এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত ক্রমানুসারে দেয়া আছে। বইটিতে ১৩৬ টি নিবন্ধ আছে এবং সূচীপত্রটি অনুচ্ছেদের মত করে দেয়া হয়েছে। এটি ছক আকারে দিলে যে নিবন্ধগুলি পাঠক একাধিকবার যখন পড়তে চান, সেগুলি খুঁজে পেতে সুবিধা হতো।
বিভূতি শব্দের অর্থ সৃষ্টার ঐশ্বর্য বা শক্তি। সুতরাং বইটির নামের অর্থ ‘অনুভবের ঐশ্বরিক শক্তি’। সবার অনুভুতির ঐশ্বরিক শক্তি থাকে না, কারো কারো থাকে। বইয়ের প্রতিটি লেখা প্রমাণ করে আকবর হোসেনের সেই শক্তি আছে। এত নিবিড় অনুভূতি, এত গভীর চিন্তা, এত নিগুঢ় দর্শন, উপলব্ধি আর জ্ঞানের প্রকাশের জন্য মা সরস্বতীকে কলমে ভর করতে হয়। ঢাকা থেকে বইটি প্রকাশ করেছে ‘উত্তরণ’ এবং প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ।
টরন্টোর মত একটি ব্যস্ত শহরে বাস করেও আকবর হোসেন হৃদয়নাথের মতো আপন জগৎ অর্থে বানপ্রস্থ তৈরি করেছেন, সেখানে তাঁর অনুভব আর ভাবনারা নির্ভয়ে আনাগোনা করে। আর তিনি ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’ হয়ে আনন্দ ও অশ্রুর মিশেলে এক মহাজীবনের গল্প বলেছেন যা সবারই মনের কথা।
আকবর হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে তিনি মুক্তচিন্তার জগতে প্রবেশ করেন। দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস বিষয়ে তাঁর রয়েছে গভীর আগ্রহ। প্রাচীন ভারতীয় দর্শন আকবর হোসেনের প্রিয় বিষয়।
আকবর হোসেন পাঠকের জন্য আরো লিখবেন সেই শুভ কামনা জানাচ্ছি।