অশ্বেত বিদেশি
লেখক ঝর্ণা চ্যাটার্জীর সম্বন্ধে জানতে পেরেছি আমার স্যার সুব্রত কুমার দাসের সাথে কোনও এক কফি গল্পের মধ্যে দিয়ে। দেশান্তরী জীবনের হাজারটা কাজ ও জীবনের কঠিন সংগ্রামের ফাঁকে স্যারই আছেন যার কাছ থেকে দেশ, দেশের মানুষ, সাহিত্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাই। শ্রেণিকক্ষের বাইরের বহু বহু ক্লাসরুমে জ্ঞানের মুক্তো বিলিয়ে যান স্যার।
স্যার বড় বড় চোখ করে খুব উৎসাহের সাথে যখন ঝর্ণা চ্যাটার্জী সম্পর্কে বলছিলেন, তখন তাঁর অজান্তেই আমি বুঝেতে পেরেছিলাম তিনি এক দুর্লভ রত্নের সন্ধান পেয়েছেন। লেখক নয় বরং ব্যক্তি ঝর্ণা চ্যাটার্জীর সম্পর্কে জানার একটা তৃষ্ণা বোধ করতে থাকি। তাই যখন জানতে পারলাম তাঁর লেখা “একটি বাঙালী মেয়ের কানাডার জীবন- কাহিনী” স্যারের হাতে এসে পৌঁছেছে তখন আর লোভ সামলাতে পারলাম না। একটি কপি সংগ্রহ করলাম। এরপরে কোনও এক অলস দিনে বইটি খুলে যে হাতে নিলাম – একদম ব্যাক পেজের ঝর্ণা চ্যাটার্জীর সৌম্য মুখদর্শনের আগে আর নামিয়ে রাখতে পারলাম না।
প্রথমেই বলে নিই – আমি সাহিত্যের ‘স’-ও বুঝি না। লেখা হল কি হল না, বই হল কি হল না – এই ব্যাপারগুলো আমি বলতে পারব না। তবে এক বসায় পাঠ শেষ করেছি এবং একজন খুব তুচ্ছ এবং সাধারণ পাঠক হিসেবে যা মনে হয়েছে, লিখতে বসে গেছি।
প্রথমেই বলে নেই বইটি অত্যন্ত সহজ পাঠ। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে আমি যেন তাঁর সামনে বসেই গল্প শুনছি। জীবনের নানাবিধ চড়াই উৎরাইয়ের কথা অবলীলায় বলে গেছেন লেখক। আদরের বাবা মা থেকে শুরু করে ভাই-বোন, খেলার সাথি, প্রতিবেশি সকলেই হয়ে উঠেছেন জলজ্যান্ত এক একটি চরিত্র। নিতুদা, রাণু, হামিদাকে নিয়ে নানা ঘটনা প্রকাশ করে তাঁর আজকের ব্যক্তিত্ব। নিরামিষভোজী হয়ে ওঠার পেছনের গল্প, তাঁর সেই ছোটবেলার রামকৃষ্ণ মঠের সন্ন্যাসীদের দীক্ষা: “তোকে কামড়াতে নিষেধ করেছি, তা বলে ‘ফোঁস’ করতে তো নিষেধ করিনি।” ৯৬ পাতার বইটি পড়তে পড়তে বারংবার তাঁর মাঝে এই কথাটারই কোনও না কোনও প্রমাণ পেয়েছি। যেমন শত প্রতিকুলতার মাঝেও তিনি তাঁর শাড়ি ছাড়েননি। জীবনের তাগিদে এগিয়ে গেছেন সামনে, পরিশ্রমের মাধ্যমে জয় করেছেন যেটাই হাসিল করতে চেয়েছেন।
তিনি গল্পে গল্পে আমাকে বিশ্বের কত শত জায়গায় নিয়ে গেছেন। ভারতবর্ষের সেই আরামবাগ গ্রাম থেকে উপশহর শহর কলকাতা পারি দিয়ে প্যারিস, লন্ডন, মন্ট্রিয়ল, উইনিপেগ, সার্নিয়া, টরন্টো, রেজাইনা কিছুই বাদ দেননি। পরবর্তিকালে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার বহু বহু দেশের নানা সব কথা। বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং জাতি বর্ণ নির্বিশেষে মানুষে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সর্বজনিন মমতার বহু বহু প্রমাণ নিজে যেমন পেয়েছেন, তেমনি প্রকাশও করেছেন। দেশ বেড়ানো এবং ভ্রমণের রোমান্চকর নেশা বহু বসন্ত পার করার পরেও তাঁকে ছাড়েনি। একজন ভদ্র সভ্য এবং তাঁর ভাষায় “ভেতো বাঙালি” দস্যি মেয়ের জীবন পার করছেন।
তিনি প্রবাস জীবন দেখেছেন যখন আমাদের ওদিককার খয়েরী মানুষ প্রবাস জীবনের প্রতি তেমন একটা আগ্রহী ছিলেন না। তিনি এসেছেন ভিনদেশে, তাও আবার কানাডার মত বৈরী আবহাওয়ার দেশে। তাঁর গল্প পড়ে মনে হয়েছে, তাঁর জীবনের চালিকাশক্তি ছিল নিজ দেশের শেকড়ের সাথে তাঁর আজীবন সখ্য। কানাডার আবহাওয়ায় নিয়মিত শাড়ি কোনও সহজ বিষয় নয়, কিন্তু তিনি তাঁর সেই পরিচয় মাথা উঁচু করে বয়ে বেড়িয়েছেন সবসময়। তাঁর ছাত্রজীবনে, শিক্ষকতায়, পারিবারিক এবং এমনকি আরসিএমপি-এর মত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা অবস্থাতেও। নিজের কৃষ্টি আঁকড়ে ধরে রাখলেও তিনি যে গোরা বা সেকেলে তা কিন্তু ননই বরং উল্টো- তিনি মিশে গেছেন নতুনের সাথে, নিজের দেশ, ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে। নিজেকে পরিবর্তন নয় বরং পরিবর্ধনের মাধ্যমে জয় করেছেন এবং যাপন করেছেন বর্ণাঢ্য এক জীবন।
তাঁর গল্পে আমরা দেখতে পাই কানাডা এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসের পরিক্রমা। তখনকার দিনে তো আর প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষুদ্রায়িত এই সমাজ প্রচলিত হয়নি, পরিবার ছেড়ে ভিনদেশে আসার প্রথমদিককার ধাক্কা, দেশিয় পণ্য সহজলভ্য না হওয়ার কষ্ট এবং নিজ ভাষায় মনের ঝাঁপি খুলে গল্প করা সবই ছিল কঠিন। সেই প্রতিকুলতাকে ভেদ করে তৈরী করেছেন বন্ধু। যেখানে গেছেন তিনি তাঁর বাঙালিত্ব নিয়ে বাড়িতে দিয়েছেন হাত এবং সেই হাত ধরার বৃহৎহৃদয় মানুষেরও অভাব হয়নি।
গল্পের ছলে আমরা জানতে পেরেছি কানাডা সমাজের না জানা বহু কথা। কেনেডিয়ানদের প্রকৃতি, তাদের উৎসব, উদযাপন, তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা সবই উঠে এসেছে তাঁর কলমে। তিনি সাক্ষি হয়েছেন বহু ঘটনার। মানুষের চাঁদে পদার্পন, পিয়ের ট্রুডোর যুগান্তকারী সময়, ওয়ার্লড ট্রেড সেন্টারে আক্রমন, মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু, করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিক, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং এর সর্বনাশা ফলাফল সবই তিনি বলে গেছেন তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে।
জীবনের এত এত প্রপ্তির মধ্যেও তিনি ছিলেন ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একজন স্ত্রী এবং মমতাময়ী মা। পরিবারের প্রতি তাঁর ভালেবাসা, ভাইবোন , মা , বাবা এমনকি ছোট্ট নারায়ণের প্রতি তাঁর প্রেমের গল্প পড়ে মনে হল তিনি একজন অত্যন্ত উষ্ণ হৃদয়ের মানুষ।
জীবনের এই গল্প বলার মাঝে মাঝে উপহার দিয়েছেন কিছু কবিতা, যা তাঁর জীবনের কথাই বলে গেছে বারংবার। কিছু আলোকচিত্র প্রমাণ করেছে আরও কত স্মৃতি। ঝর্ণা চ্যাটার্জী ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন একজন পরিণত মানুষ। আমার মানুষরা সবই নিজেদের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করতে চাই আর তাঁর গল্প পড়তে পড়তে মনে হল এমন একটি জীবন হলে কিন্তু মন্দ হত না।
বইটি প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার মূর্ধন্য প্রকাশনী থেকে। মোস্তাফিজ কারিগরের তৈরী ঝকঝকে প্রচ্ছদটি অত্যন্ত প্রসঙ্গিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছে বইটির টিপ পরিহিতা ‘বাঙালি’ মেয়ে এবং তাঁর বাসস্থান ‘কানাডা’কে।
যারা কানাডা আছেন এবং যারা কানাডা যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তাঁদের সকলের জন্যই কবি এবং লেখক ঝর্ণা চ্যাটার্জীর আত্মজীবনীমূলক বই ‘একটি বাঙালি মেয়ের কানাডার জীবন-কাহিনী’ পড়া।
মম কাজী সম্প্রতি কানাডার অগ্রগণ্য কবি এ এফ মরিৎজের কবিতার বাংলায়ন করেছেন ‘চড়ুই’ শিরোনামে।