অন্তর্বাহ: সময়ের অগ্রবর্তী এক আত্মকথন
টরন্টোপ্রবাসী বাংলাদেশি লেখক সুব্রত কুমার দাসের লেখা উপন্যাস অন্তর্বাহ একটি সরল জীবনগাঁথা। অতি সহজ-সরলভাবে লেখক এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কলেজশিক্ষক অভিমন্যু দাসকে জীবন দিয়েছেন তাঁর কলমের ধারে। এত সুন্দর করে যে বর্ণনা করা যায় জীবনের রোজনামচা, উপন্যাসটি তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।
মূলত সাহিত্য-গবেষণা, প্রবন্ধ ও অনুবাদ নিয়ে ব্যস্ত থাকা লেখক সুব্রত কুমার দাস একজন স্বভাবসুলভ লেখক। গবেষণামূলক লেখা, প্রবন্ধ কিংবা অনুবাদে যেমনটি তিনি সাবলীলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন প্রায় দুই যুগ ধরে, তেমনই প্রাণের পরশ জাগিয়ে দিয়েছে তাঁর উপন্যাস পাঠকদের হৃদয়ে। লেখক তাঁর পাঠকদের উপহার দিয়েছেন মোট ছাব্বিশখানা বই। লেখকের গুণ বিচার করার দুঃসাহস তাই আর নাইবা দেখালাম আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াসে, বরং তাঁর লেখা প্রথম ও একমাত্র উপন্যাস অন্তর্বাহ নিয়েই না হয় হোক আজকের আলোচনা।
উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের প্রত্যন্ত দুটি গ্রাম ফরিদপুরের মছলন্দপুর ও কামারখালীর মানুষ ও প্রকৃতি। লেখক নিরলসভাবে ভারতীয় ইংরেজি ঔপন্যাসিক আর কে নারায়ণের গল্পের সোমাল গ্রামের সাথে তাঁর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অধ্যাপক অভিমন্যু দাসের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও পারিপার্শ্বিক অন্যান্য বাংলাদেশি গ্রামের ভীষণ মিল খুঁজে পান। বিশেষ করে মিলে যায় নৌকায় করে সাত মাইল দূরে বেড়াতে যাওয়া অভির পিসির বাড়ির গ্রাম সাধুহাটির সাথে। আবার অধ্যাপক দাস ছাত্রদের যুক্তিও মন থেকে মেনে নেন এই ভেবে যে গল্পের পটভূমি যদি পাঠকের কাছে পরিচিত বা চেনা-জানা না ঠেকে, তবে অনেক পাঠকই পঠনের আগ্রহ হারায়। সে জন্যই লেখক যুক্তির খাতিরে মেনে নেন, কেন আজকের তরুণ পাঠকেরা সাম্প্রতিক সাহিত্যিকদের লেখনীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখান। সময় বদলেছে; বদলেছে স্থান, কাল, পাত্রের রূপ ও রস। আধুনিক লেখক সুব্রত কুমার দাস তাই গতানুগতিক ঐতিহাসিক মহামুনি, মহাজনস্বরূপ লেখকদের চাইতে আধুনিক যুগের সাহিত্যিকদের প্রতি বর্তমান যুবসমাজের পক্ষপাতিত্বকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন।
লেখকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো আত্মকথন। লেখক তাঁর কোনো ভাবনাকে সার্বজনীন বলে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি কোথাও, বরং নিজেকে প্রশ্ন করার ছলে যেন মেলে ধরেছেন যুক্তি-তর্কের উন্মুক্ত মঞ্চে। তাঁর প্রতিটি বিষয়ে পাঠককে প্রশ্ন করার বা মতামত দেওয়ার বিষয়টি পাঠককে উপন্যাসের গভীরে টেনে নেয়, সক্রিয় করে রাখে শেষ পর্যন্ত।
মূল চরিত্র অভির বাল্যকাল কাটে বাংলাদেশের আর দশটি পল্লিবালকের মতোই, বাজারে গিয়ে খেলাধুলা করে, নদীর ঘাটে গিয়ে কিংবা সন্ধ্যায় বাড়িতে বসে আলাকার (আলাউদ্দিন কাকার) গল্প শুনে। বইজুড়ে দেখা যায় লেখকের গল্প শোনার আগ্রহটি। যদিও লেখক সুনিপুণভাবে গল্পের মালা গাঁথা শুরু করেছিলেন নারায়ণের ‘আন্ডার দ্য বানিয়ান ট্রি’র নামবি চরিত্রটির গল্প বলার অসাধারণ ক্ষমতা দিয়ে, কিন্তু উপন্যাসজুড়ে পাঠক নিশ্চিত খুঁজে পান লেখকের চারপাশে বিরাজমান জনসমাজের ভালো বক্তাদের, যাঁদের অন্তত একটি দিকে বড্ড মিল, তাঁরা সবাই ভালো গল্প বলতে জানেন। লেখকের আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখা যায় জাত-কুল-বংশ ছাপিয়ে একজন ভালো বক্তার গুণ প্রকাশে। তিনি সরল চিত্তেই তাই মেনে নেন সব মানুষেরই কিছু না কিছু গুণ থাকে। তা তিনি শিক্ষক হন বা কর্মকার। এ ছাড়া আরেকটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য আমরা খুঁজে পাই লেখকের গল্পে, তা হলো শিক্ষককুল ও শিক্ষকতা পেশার প্রতি লেখকের গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ। বাল্যকালের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে একে একে তাই যত শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন অভি, তাঁদের সবার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। বিজ্ঞানের ইসলাম স্যার, পিটি শিক্ষক সুধীর স্যার, নাপিত থেকে হওয়া মৃদঙ্গ শিক্ষক, ইংরেজির সুজাউদ্দিন স্যার, দেবেনবাবু, নন্দ স্যার, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষকদের শিক্ষকতার ধরন নিয়ে লেখকের মতামত ও নিপুণ পর্যবেক্ষণক্ষমতা সত্যিই যথেষ্ট বাস্তবতার দাবিদার। লেখকের এ-বিষয়ক মন্তব্যগুলো সত্যিই প্রশংসনীয়। বর্তমানের যান্ত্রিক জীবনে নৈতিক অবক্ষয় ঠেকাতে অভিমন্যু দাসের মতো শিক্ষক বড়ই প্রয়োজন, যাঁরা কেবল শ্রেণিকক্ষের ‘স্যার’ হওয়ার জন্যই নন, নিজেকে নিয়োজিত রাখেন একজন ছাত্রের সারাজীবনের আদর্শ হওয়ার জন্য। শিক্ষক যখন বন্ধু হয়ে যান, তখনই কেবল একজন ছাত্রের ভেতরে ফুটিয়ে তুলতে পারেন সত্যিকারের কমল ফুল। ছাত্রের সাথে মন খুলে কথা বলা না গেলে যে দূরত্ব তৈরি হয়, সেই দূরত্বের সেতু ডিঙিয়ে যায় না খুঁজে পাওয়া ঝিনুক চিরে মূল্যবান মুক্তো।
উপন্যাসটি ক্রমশই তার জাল বিস্তার করতে থাকে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিসেনা, রাজাকার এবং তৎকালীন সমাজের চলমান ঘৃণ্য ও হীন ধর্মীয় কোন্দলকে ঘিরে। একপর্যায়ে যেখানে একটু করে উঁকি দেয় সমসাময়িক রাজনীতি। লেখক তাঁর লেখায় মানবিকতার প্রচুর নিদর্শন দেখিয়েছেন, সাধুবাদ জানিয়েছেন স্কুল অ্যাসেম্বলিতে কোরআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক—সব ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করে ছাত্রদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ বোনার প্রচেষ্টাকে। অভির স্মৃতির পাতা উল্টে লেখক দেখান, কী সুন্দর ও সাবলীলভাবে একদা হিন্দুরা শবেবরাতে আড়পাড়া গ্রামে মুসলিম বাড়িতে আসত হালুয়া-রুটি খেতে, একইভাবে তাঁর বাবার মুসলিম বন্ধুরাও হিন্দু বাড়ির পূজায় নাড়ু, বাতাসা, পায়েস, তক্তি ইত্যাদি ভক্তিভরে খেতেন। ছিল না সে সময় কোনো ঘৃণ্য ধর্মীয় রাজনীতি কিংবা ভেদাভেদ। তাই তো অভিরা পূজার মতো ঈদ উদ্যাপনের জন্যও নতুন জামা কিনত, রোজার মাসে নিয়ম করে দু-একবার ইফতার মাহফিলও করত। আসলে সে সময়টিতেও হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই বলেই মানুষ মানুষকে মূল্যায়ন করত। জাতিগত বিদ্বেষ, কিংবা ‘বিষ’ ছড়ানো ছিল না সামাজিক পরিমণ্ডলে। তিনি সমাজব্যবস্থাকে নিয়ে সহজ সুরে যে খেজুরকাঁটার মতন তীক্ষ্ণ খোঁচাগুলো দিয়েছেন, তা যেকোনো সমাজেই বিবেচ্য হওয়া বড় প্রয়োজন।
ক্রমে লেখক আলোকপাত করেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাতির জনককে হত্যার ঘটনা, রক্ষীবাহিনীর নির্মমতা, পন্টুনের ওপর দাঁড়িয়ে কোমলমতি কিশোরদের ভীরু বক্ষে লাশ ভেসে ওঠার ঘটনা পর্যবেক্ষণের মুহূর্ত, এলাকার আতঙ্কিত জনগণ ইত্যাদি।
খুব ভালো লেগেছে লেখক যখন লিখেছেন, কামার আলাউদ্দিনকে ‘বাবার ভাই কাকা’র জায়গায় দেখেন অভি, তাই তাঁকে ডাকতেন ‘আলাকা’ বলে। কামারদের অবদান বর্ণনার ছলে অভি যখন ছাত্রদের শেখান প্রত্যেকে কী করে অন্যের জন্য এবং পরোক্ষভাবে সমাজের জন্য কাজ করে যেতে পারে, তা-ও শিক্ষণীয় বটে। এসব নৈতিক শিক্ষা কী চমৎকারভাবেই না সুব্রত কুমার দাস তাঁর উপন্যাসে দিয়েছেন গল্পের ছলে! অভির বই পড়া, সংগ্রহ করা আর অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার ব্যাপারটিও নিশ্চিত সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার।
সত্যি কথাগুলো সরাসরি বলার জন্য যে সাহসিকতা প্রয়োজন, তা নিঃসন্দেহে লেখক সুব্রত দেখিয়েছেন। যেমন: জালাল কাকার ভোটের মিছিল, তা দিয়ে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে পূজা পালন, পাকিস্তানি বাহিনির ধর্মীয় আক্রোশ, বেছে বেছে হিন্দুদের দোকানপাট পোড়ানো, মালামাল লুট করানো ইত্যাদি ঘৃণ্য দিকগুলো আসলেও তো বাদ দেওয়া যায় না স্মৃতি থেকে। বিবেকবান মানুষ মাত্রই সেই দিনগুলোর কথা ভেবে অনুতাপ করতে বাধ্য, তা এরই মধ্যে যত জলই গড়িয়ে যাক না কেন গড়াই নদ দিয়ে!
তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, লেখক সুব্রত কুমার দাসের লেখনীতে যুগ পরিবর্তনের পরিষ্কার আভাস। যে বাংলায় এককালে পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে মুসলিমরা হিন্দু প্রতিবেশীদের লুকিয়ে রাখত নিজ গৃহে, আজ সেই মুসলিমরাই পুড়িয়ে ফেলছে হিন্দুদের বাড়িঘর। সত্যিই বদলেছে সময়, তবে এই পরিবর্তনটি মোটেও সুখকর নয় সমাজের জন্য। এ বড়ই তিক্ত, ঘৃণ্য, নিন্দনীয় ও বর্জনীয়। যদিও অন্তর্বাহ উপন্যাসটির প্রকাশকাল ২০১৩ সাল, কিন্তু হয়তো জ্ঞানী পর্যবেক্ষক সুব্রত কুমার দাস সময় পরিবর্তনের হাওয়াটা আঁচ করতে পেরেছিলেন কিছু আগেই, তাই তো বড্ড মিলে গেছে তা এই ২০১৭-এর প্রেক্ষাপটের সঙ্গে পুরোপুরিভাবে। তাঁর রচিত সময়ের গান অন্তর্বাহ তাই সবার জীবনেই যেন বড্ড চেনা, ভীষণ জীবনঘেঁষা এক উপন্যাস।