অনুভবের বিভূতিতে এক সুখপাঠ্য আলোকিত রচনা

মহসীন হাবিব

একজন মানুষের মধ্যে একা একা আলো ধরা দেয় না। পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক শিক্ষা, স্কুল-কলেজের পাঠ ও সাহচর্য এবং সমৃদ্ধ মানুষের কাছ থেকে পাওয়া দর্শন ও সান্নিধ্য মানুষকে পরিণত করে তোলে। মানুষের অনুভূতিগুলোকে নাড়া দিতে সর্বাধিক অবদান রাখেন আলোকিত মানুষেরা তাদের দর্শন ভাবনা দিয়ে। এবং এই আলোকিত মানুষদের অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে বিনিসুতোর বন্ধন তৈরি করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো তাদের লেখা বই।

কিন্তু সব বই-ই কি মানুষের অনভূতিকে নাড়িয়ে দিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারে? না, পারে না। বাঙালি জাতি, বাঙালি সমাজ বা জনপদ যা-ই হোক, তাকে প্রথম নাড়িয়ে দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারপর রবীন্দ্রনাথ। এর আগে পরে অনেক প্রতিভাবান ও আলোকিত মানুষের জন্ম হলেও রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন বটবৃক্ষ, বাংলার জাতি গঠন, মননশীলতা ও আত্মপরিচয় আজও যার ছায়াতলে জেগে থাকে। হয়তো লেখার ধরন, বিষয় এবং সময় আলাদা, কিন্তু প্রতিটি বাঙালির মানসে জ্ঞাতসারে এবং অজান্তে রবীন্দ্রআবহ অনুরণিত হয়। অনুভবের বিভূতিতে গ্রন্থের লেখক আকবর হোসেনও এর ব্যতিক্রম নন। বরং রবীন্দ্রনাথের প্রভাব তার ওপরে যে প্রকট, সে কথা তার কলম চালনার ডগায় স্বীকারোক্তির সঙ্গে জেগে উঠেছে।

অনুভবের বিভূতিতে বইটি নিয়ে লিখছি এই কারণে যে এটি এক ব্যতিক্রমধর্মী সুখপাঠ্য গ্রন্থ—যা মানুষের অন্তর্দৃষ্টিকে নাড়িয়ে দেওয়ার শক্তি রাখে। এটি একটি নিজের দেখা ও স্মৃতিচারণ; বক্তব্যধর্মী বই। একইসঙ্গে বহুরসে ঋদ্ধ। তিনি তার পরিণত চোখে যা দেখেছেন, তা-ই সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করেছেন। আর তা করতে গিয়ে সাধারণকে করে তুলেছেন অসাধারণ। তিনি যখন তার বন্ধু নিরঞ্জনের প্রেম ও ত্যাগের কথা লেখেন, খেতমজুর রশিদের সাতদিনের শিশুর মৃত্যুতে গ্রামের ললিত মোহন কাকা যখন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন, তখন তা উপন্যাসের চরিত্র হয়ে ওঠে। অথচ কল্পকাহিনী নয়, চোখে দেখা ঘটনা। তার প্রতিটি স্মৃতিচারণ আবেগে ভরপুর। সে আবেগ বাস্তববিবর্জিত নয়। এ কারণেই আকবর হোসেন আলাদা।

অনুভবের বিভূতি গ্রন্থে আকবর হোসেনের জীবনদর্শন ফুটে উঠেছে সকালের সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা গাঁদা ফুলের মতো। তাঁর সে দর্শন রবীন্দ্রনাথ, জীবনাননন্দ থেকে শুরু করে ফিঙে পাখি, খড়ম বা মানবশিশুর নাম পচা রাখা পর্যন্ত বিস্তৃত। আকবর হোসেনের চিন্তা, তাঁর ধর্ম-দর্শনের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হই ফেসবুক থেকে। ফেসবুক মানুষের চিন্তার ধরন, উচ্চতা—সবকিছু বুঝিয়ে দেয়। নিজেকে লুকিয়ে রাখা যায় না। সেখান থেকেই তাঁর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠা।

আকবর হোসেনের সূক্ষ্ম রসবোধ এতটাই সূক্ষ্ম যে, হেসে হেসে তা গ্রহণ করা যায় না, গম্ভীর হয়ে, সিরিয়াস পাঠক হয়ে গ্রহণ করতে হয়। আকবর হোসেনকে উঁচু মাপের চিন্তক ও লেখক বলতে আমি বিনাদ্বিধায় হাত তুলতে চাই।

আলোচনাটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে প্রকাশিত।