অটিসম কোনো অভিশাপ নয় একটি সময়োপযোগী গ্রন্থ

সামিনা চৌধুরী

“অটিসম কোনো অভিশাপ নয়” তাসমিনা খানের লেখা প্রথম বই। বইটিতে অটিসম সমস্যাক্রান্ত বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন মাইলস্টোন, ডেভেলপমেন্টাল স্টেজ, নানা উপসর্গ, চ্যালেঞ্জ, আর সেইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার কিছু উপায় বর্ণনা করা হয়েছে।

কানাডা প্রবাসী লেখক তাসমিনা খান ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন । সাহিত্য পড়তে গিয়ে মানবমনের বিশ্লেষণ করতে করতে তিনি মানব চরিত্রের বিচিত্র গতিবিধির প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং কানাডায় আসার পর বিহ্যাভিয়ার এনালাইসিসে আবারও অনার্স ও মাস্টার্স করেন।

বিজ্ঞান প্রতিদিন এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসাশাস্ত্র। আর তাই মনের রোগ আর শরীরের রোগ এখন আলাদা করেই নির্ণয় করা হচ্ছে। মনের রোগ নিয়ে কাজ করতে গিয়েই মানুষের একটি বিশেষ মানসিক গঠনের সাথে বিজ্ঞানীদের পরিচয় হয়।এই মানসিক গঠনটি যাদের থাকে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এই বাধাগ্রস্ততাকে অটিসম বলে। অটিসম কোনো রোগ নয়, এটি একটি বিশেষ মানসিক গঠন। কাজেই এটি শতভাগ নিরাময়ের কোনো ওষুধ না থাকার কারনে থেরাপির মাধ্যমে সমস্যাক্রান্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবন যাপনের উপযুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা হয়।

বইটিতে অটিসম কেন হয়, কীভাবে অটিসম হয়, কোন বয়সে বোঝা যায় যে অটিসম হয়েছে, এটি কীভাবে সনাক্ত করা যায়, এ বিষয়ে যারা সহায়তা করেন তাদের কী ধরনের পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়, অটিসম সনাক্ত করার পর চিকিৎসা সহায়তার ধাপগুলো কেমন, ইত্যাদি বিষয়াবলি নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনা শেষে কিছু কেসস্টাডি দেয়া হয়েছে, যেখানে এই তাত্ত্বিক আলোচনার ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখানো হয়েছে।

বইটিতে দেয়া কেস স্টাডিগুলো সত্য ঘটনা। কিন্তু পেশাদারিত্বের খাতিরে নাম প্রকাশ করা হয়নি

প্রতিটা কেসস্টাডিতে সমস্যাক্রান্ত মানুষটির সমস্যাগুলো এবং সেগুলো সমাধানের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেটা বলা হয়েছে। বইটি পড়ে পাঠক জানতে পারবেন যে অটিসম সমস্যাক্রান্ত প্রতিটি মানুষ আলাদা, তাদের উপসর্গগুলোও আলাদা। কাজেই এটি নিরাময়ের জন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি সবার জন্য প্রযোজ্য নয়।

বইটি রচনার কারণ হিসেবে লেখক নিজেই বলেছেন – ” আজকাল দেখা যায়, আমাদের এশিয়ান অসংখ্য পরিবারে অটিস্টিক বাচ্চাদের নিয়ে বিব্রত তাদের পরিবার ও কেয়ারগিভাররা। এতে বিব্রত না হয়ে, সময় এসেছে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে, তাদের যথাযথ থেরাপির ব্যবস্থা করে, তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া। আর সেই কারনেই এই বই লেখা শুরু করেছিলাম।”

যেসব অভিভাবক নিজেদের সন্তানের জন্য অটিজম মোকাবিলা করছেন, যারা ভাবছেন শিশুটির সাথে কী রকম আচরণ করা উচিত, ভাবছেন আরো কী কী ধরনের সহায়তা পাওয়া যেতে পারে, তাদের জন্য বইটি একটি চমৎকার নির্দেশনা সহায়ক পুস্তক। বইটির ব্যবহার উপযোগিতা সম্পর্কে লেখক ভুমিকাতে যথার্থ প্রত্যাশা করে বলেছেন – “এই লেখা মূলত সেই সব অভিভাবকের জন্য লেখা, যারা পরিবারের মাঝে একজন অটিসমে শনাক্ত সদস্য নিয়ে বিব্রত, বিভ্রান্ত কিংবা আশার আলোক হারিয়ে হতাশাগ্রস্থ। বইটিতে এমন অনেক সত্য ঘটনা রয়েছে, যা আপনাকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে, জোগাবে নতুন আশার আলো।”

কেসস্টাডিগুলো অভিভাবকদের জন্য খুব সহজ করে লিখেছেন লেখক। এটি পড়ে অভিভাবকেরা বিভিন্ন তথ্য জানার পাশাপাশি কিভাবে শিশুটির সাথে শিখন প্রক্রিয়া চালাতে হবে তার জন্যও নির্দেশনা পাবেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কীভাবে বিএসটি বা বিহেভিয়ারেল স্কিলস ট্রেনিং দিতে হবে সেটা বোঝানোর জন্য লেখক বলেছেন –

“১. প্রথমে শিক্ষার্থীকে নির্ধারিত স্কিলসটি বুঝিয়ে বলা হয়।

২. এরপর তাকে লিখিতভাবে ঐ স্কিলের এনালাইসিস দেয়া হয়, যাতে ধাপে ধাপে বর্ণনা করা থাকে, কীভাবে কাজটি করতে হবে। যারা পড়তে পারে না, তাদেরকে ছবি এঁকে বা তীর চিহ্ন দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

৩. এ পর্যায়ে ট্রেইনার নিজে ওই লিখিত বা অংকিত ধাপগুলো ক্রমান্বয়ে করে দেখিয়ে দেবেন বাস্তবে তা কেমন দেখাবে।

৪. এবার শিক্ষার্থীকে বলা হবে তা অনুকরণ করে দেখাতে।

৫. এই পর্যায়ে ট্রেইনার শিক্ষার্থীকে ফিডব্যাক দিবেন, কোনো কোনো ধাপ সঠিক হয়েছে আর কোনো ধাপগুলো আরও চর্চা প্রয়োজন সে ব্যাপারে।

একটি চেক লিস্টে ট্রেইনার নোট করবেন শতকরা কত ভাগ সফল হয়েছে শিক্ষার্থী সে হারটি।”

অটিসম শনাক্ত সন্তানকে কোন কিছু শিখাতে হলে অভিভাবকেরা এই ধাপগুলো অনুসরণ করতে পারেন এবং একই সাথে অটিসম সম্পর্কে জেনে, তাঁদের ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

বইটি একই সাথে কিছুটা একাডেমিক। অর্থাৎ যারা অটিসম নিয়ে কাজ করতে চান, তাঁরা বইটি পড়ে অবশ্যই উপকৃত হবেন। অটিসম সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরণের সংজ্ঞা, এ পর্যন্ত কী কী গবেষণা হয়েছে, গবেষণা লব্ধ তথ্যগুলি কী কী এবং সুপারিশকৃত করণীয় কী কী ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে। বইটিতে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দুটো দিকেই আলোকপাত করা হয়েছে, যেটি শিক্ষার্থীদের উপকারে আসবে। বইটির ভেতরে অটিসম সংক্রান্ত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ডায়াগ্রাম উপস্থাপন হয়েছে, যে গুলো যারা এই বিষয়ে পড়াশোনা করছেন, তাদের জন্য বেশ উপযুক্ত হয়েছে। অটিসম বিষয়ে প্রতিটা তথ্যের তথ্যসুত্র আছে, শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা করলে তথ্যসূত্রগুলোও বিস্তারিত পড়তে পারবেন। এটা বলাই যায় যে বাংলা ভাষায় লেখা এই বইটি বাঙালি শিক্ষার্থীদের জন্য খুব সহায়ক একটি গ্রন্থ।

লেখকের ভাষায় – “অটিসম কোন অভিশাপ নয়, এটি একটি মানুষের ধরন। একজন নন অটিস্টিক মানুষ যা যা করতে পারে, যথার্থ চিকিৎসা আর ট্রেনিং পেলে একজন অটিস্টিক মানুষও তেমনি সব করতে পারে। তাদের গতি কিংবা ধরনটা হতে পারে ভিন্ন। একজন কালো মানুষ যেমন চাইলেই সাদা হতে পারেন না, একজন সাদা মানুষ চাইলেই তেমনি কালো হতে পারেন না।”

তেমনি অটিস্টিক মানুষেরা ইচ্ছা করলেই অন্যদের মত হতে পারেন না। এই বিষয়টিকে মানব বৈচিত্র্য হিসেবে দেখতে হবে এবং সেভাবেই আমাদের জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। যেহেতু বিভিন্ন স্তরের অটিজম সমস্যাক্রান্ত মানুষ আমাদের সমাজেরই অংশ, তাই এ বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

সেই কারণে, যাদের পরিবারে অটিসম সমস্যাক্রান্ত মানুষ নেই, যারা হয়তো অটিসম নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করছেন না, তাঁরাও বইটি পড়ে উপকৃত হবেন। খুব সহজ করে উদাহরণ দিয়ে অটিসম এর মত জটিল বিষয়টি লিখা হয়েছে। কী কী সহায়তা পাওয়া যেতে পারে, সহায়তা পাওয়ার স্তরগুলি কী কী, কী পরিমাণ সময় লাগতে পারে এবং অটিসম সমস্যাক্রান্ত মানুষের সাথে কী ধরনের অচরন করা উচিত… এসব তথ্য খুব ক্রমানুযায়ী বলা হয়েছে। কাজেই বইটি সবারই পড়ে রাখা উচিত।

বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। উজ্জ্বল লাল রঙের পটভূমিতে দুটি শিশু এবং একটি প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের মাথার অবয়ব এবং উড়ে যাওয়া প্রজাপতি মানব মস্তিষ্কের অজানা অধ্যায়ের প্রতীক বলে আমার মনে হয়েছে। পেছনের লাল রং এবং কিছুটা হালকা হয়ে আসা পটভূমি প্রচ্ছদটিকে আরো আকর্ষণীয় করেছে।

বইটিতে তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি অনেকগুলো কেসস্টাডি আছে। অবশ্যই ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আসল নাম পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। কেস স্টাডিগুলো এই বইটির প্রাণ। প্রতিটি কেসস্টাডি আলাদা, কেস স্টাডিগুলোতে উপস্থাপিত মানুষগুলোর অটিসমের লক্ষণগুলো আলাদা এবং প্রতিটি মানুষকে আলাদা আলাদা থেরাপি দেয়া হয়েছে এবং মানুষগুলো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে। এই কেস স্টাডির তথ্যগুলো লেখক খুব পেশাদার প্রশিক্ষকের মত ধাপে ধাপে দিয়েছেন।

বইটি পড়তে পড়তে কেস স্টাডির মানুষগুলোর জন্য পাঠকের মনে মমতা তৈরি হবে। পাঠক অনুভব করতে পারবেন এই বিশাল রহস্যময় পৃথিবীর কত কিছু আমাদের অজানা, আমরা এই বিরাট রহস্যময় প্রকৃতির কাছে কত অসহায়। পাঠক অনুভব করবেন প্রকৃতির খেয়ালে এই অটিজম সমস্যাক্রান্ত নিষ্পাপ মানুষেরাও এই পৃথিবীর সকল আনন্দের সমান অধিকার রাখে। সেই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার। বইটির শেষে লেখকের সাথে পাঠকও বলবেন, “পৃথিবীর সকল শিশুই যেন সম-অধিকার পায়, সম-সুবিধা পায়, এটুকু নিশ্চিত করাই আমাদের মূখ্য লক্ষ হোক, জয় হোক মানবতার। তাই বুঝি সেই মধ্যযুগীয় কবি বড়ু চন্ডীদাস বলে গিয়েছিলেন, “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।”

এ ধরনের গবেষণা পুস্তক বাংলায় এত সহজ করে লেখার জন্য লেখক অবশ্যই অনুসরণীয় উদাহরণ স্থাপন করেছেন এবং পাঠক অপেক্ষায় থাকবে এ ধরনের আরও গবেষণা গ্রন্থের জন্য।

“অটিসম কোনো অভিশাপ নয়” তাসমিনা খানের লেখা প্রথম বই। প্রকাশ করেছে মূর্ধন্য, ঢাকা । প্রকাশকাল ২০২৩।

……………

সামিনা চৌধুরী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন। সরকারি কলেজে অধ্যাপনাকালে বাংলাদেশ ইউনেস্কো কমিশনেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে যুক্ত হন ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশে-বিদেশে সামিনার মোট নয়টি পিয়ার রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে কানাডায় অভিবাসী সামিনা পাঁচ বছর ধরে টিডি ব্যাংকে কাস্টমার কেয়ার বিভাগে কাজ করছেন।