কম-জানা, অজানা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে
রেশমা মজুমদার শম্পা
অধিকাংশ বাঙালি মন ও মননে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ধারণ করেন । এই দুই কবিকে নিয়ে স্বনামধন্য লেখক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাসের কাজের পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত। বছর খানেক আগে আমি তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ: কম-জানা অজানা’ বইটি পড়ার সুযোগ পাই। সেই বই নিয়ে বর্তমান লেখা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি পৃথিবী। তাঁকে জানার যেন কোন শেষ নেই। শতবর্ষ-প্রাচীন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অত্যন্ত কৌতুহলউদ্দীপক অজানা তথ্য সুব্রত তাঁর সহজাত ও সরস ভাষায় পাঠকদের কাছে এই বইয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এটি পরিশ্রমসাধ্য গবেষণা গ্রন্থ কিন্তু একইসাথে সুন্দর সাহিত্যের দাবীদার অবশ্যই। বইটি রবীন্দ্র-গবেষণার নতুন আলোক উন্মোচিত করবে। যারা রবীন্দ্রনাথকে আবারও নব আঙ্গিকে আবিষ্কার করতে চান তাদের জন্য এই বইটি একটি অন্যতম মাইলফলক।
বইটিতে বারোটি অধ্যায় আছে । প্রতিটি অধ্যায় নতুন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আর তাঁকে নিয়ে যারা ভেবেছেন, কাজ করেছেন তাঁদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়। সুব্রতর লেখার ঢঙটি রবীন্দ্রনাথের অজানা অধ্যায় সম্পর্কে পাঠকের মনে ভীষণ আগ্রহ তৈরী করে দেয় এবং পাঠক অনায়াসে এক অধ্যায় থেকে আরেক অধ্যায়ে ছুটে যান । এটাই লেখকের মুনসিয়ানা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু ভারত বা বাংলাদেশই নয়; পাশ্চাত্য, এশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় যে তুমুল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তা সুব্রত কুমার দাসের বইটিতে চমকপ্রদভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রথম প্রবন্ধটি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ১৯১৩ নিয়ে। এই প্রবন্ধে প্রথম অশ্বেতাঙ্গ এবং বিশ্বের কাছে একেবারেই অচেনা হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল বিজয়ের ঘটনাটি পড়ে সত্যি আশ্চর্য হই – এর বিবরণ, নানা তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে সুব্রত পাঠককে অজানা এক অধ্যায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। সেই সময়ে ভারত ও বিদেশের বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক যারা মনোনয়ন তালিকায় ছিলেন তাঁদের সম্পর্কে জানার কৌতুহল উদ্রেক করে একটি মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ হাজির করেছেন বইটির লেখক।
বিশেষ করে জানতে পারি খোদ সুইডেনের খ্যাতিমান কবি কার্ল গুস্তাফ হেইডেন ভন স্টামের (১৮৫৯-১৯৪০) নাম তালিকায় থাকা সত্ত্বেও তিনি ব্যর্থ হন; পরে ১৯১৬ সালে নোবেল অর্জন করেন সাহিত্যে। সুব্রত তার ভীষণ রকম অনুসন্ধানী চোখ ও হৃদয় দিয়ে ঘটনার ধারাবাহিক ও সহজ প্রকাশে পাঠককে মুগ্ধ ও বিস্মিত করেন।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি অত্যন্ত চমৎকার। অচেনা একজন রবীন্দ্র গবেষক ও বিশ্ববিখ্যাত প্রতিভাধর ইতিহাসবিদ বিনয়কুমার সরকারের সাথে নতুন দিনের পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন লেখক। হারিয়ে যাওয়া একজন রবীন্দ্র ভাষ্যকার বিনয় কুমার সরকারের রবীন্দ্রনাথ নিয়ে নিরলস কাজের নানা দিক অতি সহজ সুন্দর করে লেখক তুলে এনেছেন ।
তৃতীয় প্রবন্ধে পাঠক রবীন্দ্রনাথের প্রথম ইংরেজি জীবনী লেখক অধ্যাপক বসন্ত কুমার সম্পর্কে পাঠক জানতে পারে। রবীন্দ্রনাথের স্নেহদৃষ্টি যিনি পাননি সে বিস্মৃতির ইতিহাস সুন্দর করে তুলে ধরে আমাদের লেখক সুব্রত তার লেখার মাধ্যমে জানিয়েছেন যে এটি একটি ভুল ধারণার বিষয় ছিল । অত্যন্ত মনোগ্রাহী এই প্রবন্ধ ।
চতুর্থ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নব নব আঙ্গিকে জীবনীর প্রকাশ সম্পর্কে বিস্ময়কর সব তথ্য রয়েছে। শান্তিনিতেনের ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক অজিতকুমার চক্রবর্তী (১৮৮৬-১৯১৮) রবীন্দ্রনাথ নামে একটি জীবনী লেখেন যা ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় । রবীন্দ্রনাথের জীবনচরিত এবং তার কাব্যযাত্রাকে যুগপৎভাবে দেখাই ছিলো অজিত কুমারের লক্ষ্য । রবীন্দ্রনাথ নামক পরিচিত সাগরকে শতবর্ষ আগে তার জীবনী লেখক অজিত কুমার কেমন দেখেছেন সেই চমকপ্রদ তথ্য আমরা সুব্রত কুমারের সরস লেখার অনায়াস চেষ্টায় জানতে পারি।
পরবতী অধ্যায় (পঞ্চম প্রবন্ধে) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগ্রন্থের প্রথম ইংরেজি ভাষার অনুবাদক সাহিত্যিক রজনীরঞ্জন সেন বিষয়ে একটি মনোজ্ঞ নাতি দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া এক রবীন্দ্র অনুবাদক যিনি পেশাগত জীবনে চট্রগ্রামের আইনজীবি ছিলেন তাঁকে আমরা চিনতে পারি সুব্রত কুমারের লেখায় যা নতুন প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্র গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করতে সাহায্য করবে।
ষষ্ঠ প্রবন্ধটি অত্যন্ত কৌতুহল-উদ্দীপক। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বেশকিছু আলোচনা প্রকাশিত হয়েছিলো তাঁর নোবেল পাওয়ার পর। দারুন সব তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে এই বিষয়ে লেখক চিত্তাকর্ষক আলোচনা করেছেন। সপ্তম প্রবন্ধটি নিউইয়র্ক ট্রিবিউনে রবীন্দ্র প্রসঙ্গ নিয়ে প্রকাশিত অজানা তথ্যাদি নিয়ে লিখিত। ১৯১৩ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত কবিকে নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যা রবীন্দ্রচর্চার একটি মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হবে।
অষ্টম প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের একটি অজানা সাক্ষাৎকার সম্পর্কে জানা যায়। এই সাক্ষাৎকারটি ইতিহাসের একটি বিরল সংযোজন যার কথা আগে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। ঝিনুকের বুক থেকে মুক্তো আহরনের মতই একটি চমৎকার কাজ এটি লেখকের।
নবম প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির সংবাদ সুদূর অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে তাঁকে নিয়ে যে আলোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিলে সে সম্পর্কে বিশদ সরস আলোচনা রয়েছে। দশম প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ পরিকল্পনা আর তা অপূর্ণ থাকার গল্পটি অত্যন্ত প্রাঞ্জলতার সাথে বর্ণিত হয়েছে।
একাদশ প্রবন্ধটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ একজন স্বাধীনতাকামী ইংরেজ বিদ্বেষী নাগরিক ছিলেন। তাই ইংরেজদের কাছে উনি খুব প্রিয় ভাজন ছিলেন না তা ইতিহাসের সাক্ষী। ইংরেজ-বিদ্বেষী রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে জাপানে এসে পাশ্চাত্য-অনুসারী জাপানের তীব্র সমালোচনা করেন। অন্যদিকে জাপানের কট্টর জাতীয়তাবাদীদের কর্মকাণ্ডকে কটাক্ষ করে তাদের খেপিয়ে তোলেন। আমরা সুব্রত কুমারের অনুসন্ধানী লেখার মাধ্যমে এই অধ্যায়ে জানতে পারি কোমাগাতা মারু জাহাজের ঘটনাটি। যে আন্তর্জাতিক ঘটনাটি কবিগুরুকে বিচলিত করে তুলেছিলো প্রচণ্ডভাবে। মারু জাহাজে পাঞ্জাব থেকে ৩৭৬ জন যাত্রী কানাডায় পাড়ি জমান। তাদের জাহাজ কানাডা সরকার তীরে ভিড়তে দেয়নি। তারা ভারতের উদ্দেশ্য রওয়ানা হয় ও কলকাতা বন্দরে তাদের উপর বৃটিশ পুলিশ গুলি চালায়। এই অমানবিক ঘটনা ও রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়ার চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন সুব্রত কুমার দাস।
আমরা জানতে পারি যে ১৯১৮ সালে হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলায় রবীন্দ্রনাথের নামটি যুক্ত হয়ে যায়। এর পরবতীকালে আমেরিকা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আবেগ ও উষ্ণতা অনেক কমে গিয়েছিলো। দুর্লভ এইসব ঘটনার জমজমাট আলোচনা সুব্রত স্বাভাবিক সহজাত ভাষার দক্ষতায় প্রকাশিত করেছেন এই প্রবন্ধে।
দ্বাদশ প্রবন্ধটি আমেরিকার শিকাগো শহর থেকে প্রকাশিত অতি প্রাচীন কবিতাপত্র পোয়েট্রিতে রবীন্দ্র প্রসঙ্গ নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ ও প্রতিবেদন নিয়ে একটি অনবদ্য আলোচনা রয়েছে । সেই সাথে এই প্রবন্ধে পোয়েট্রি পত্রিকার প্রচ্ছদের কিছু দুর্লভ ছবি সংযোজিত হয়েছে।
লেখক, সাহিত্যিক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাস ‘রবীন্দ্রনাথ: কম-জানা, অজানা’ বইটি শত বছরের পুরনো রবীন্দ্রনাথকে পড়তে পড়তে আবিষ্কার করেছেন। বাঙালির সীমা ছাড়িয়ে বইটির আরও অনেক প্রসারের জন্য এর একটি ইংরেজি সংস্করণ আবশ্যক। আমি বইটির বহুল প্রচার আশা করি ।
চিকিৎসক ও অধ্যাপক রেশমা মজুমদার শম্পা টরন্টোর বাসিন্দা।